দেশজুড়ে

এরশাদের মরদেহবাহী গাড়ি চালিয়েছেন সিটি মেয়র মোস্তফা

শেষ পর্যন্ত অসিয়তকৃত পল্লী নিবাসের লিচু বাগানেই সমাহিত হলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তবে এর পেছনে যে গল্প তার প্রধান কারিগর হলেন রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।

Advertisement

এরশাদের চতুর্থ ও শেষ জানাজা শেষে কালেক্টরেট মাঠ থেকে মরদেহ বহনকারী গাড়ি চালিয়ে পল্লী নিবাসে পৌঁছান সিটি মেয়র। ফলে বাধ্য হয়ে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে মরদেহ দাফনের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেন কেন্দ্রীয় নেতারা। লাখো নেতাকর্মীর ভালোবাসায় মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় পল্লীবন্ধুকে।

জানাজায় অংশ নিতে আসা উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানান, দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে ফ্রিজিং গাড়িতে রংপুর সেনানিবাস থেকে এরশাদের মরদেহ আনা হয় কালেক্টরেট ঈদগাহ ময়দানে। এরপর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেয়া হয়। পরে সেখানে একটি মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সিটি মেয়র, ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতি ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা।

এরশাদের মরদেহ আনার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় কালেক্টরেট ঈদগাহ ময়দান। মানুষের ঢল চলে যায় আশেপাশের রাস্তা ও প্রধান সড়কে। এরই মধ্যে এরশাদের সমাধি রংপুরে দিতে হবে এই দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন দলীয় নেতাকর্মীরা। স্লোগানের মধ্যেই মাইকে বক্তব্য দিতে থাকেন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতারা। বিক্ষোভ বেড়ে গেলে বেলা ২টার দিকে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঘোষণা দেন, ‘স্যারের মরদেহ আমাদের কাছে আছে। কেউ মরদেহ নিয়ে যেতে পারবে না। রক্তের বিনিময়ে হলেও পল্লী নিবাসেই স্যারের সমাধি আমরা করব।’

Advertisement

এরপর শুরু হয় জানাজা নামাজের প্রস্তুতি। জানাজার প্রস্তুতির মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা ও এরশাদপুত্র সাদ এরশাদ।

জিএম কাদের বক্তব্য দেয়ার সময় এরশাদকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকায় সমাহিত করার ইঙ্গিত দিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এসময় লাখো জনতা সেখানে বিক্ষোভ করতে থাকেন এবং ‘রংপুরে সমাধি চাই’ দাবি তোলেন। শুরু হয় উত্তেজনা। মঞ্চের মধ্যে উত্তেজনা বেশি ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে মেয়র মোস্তফা জিএম কাদেরের হাত থেকে মাইক নিয়ে ঘোষণা দেন, স্যারের সমাধি পল্লী নিবাসেই হবে। জানাজার প্রস্তুতি নিন। এরপর আড়াইটায় শুরু হয় জানাজা।

জানাজা শেষে আবারও মরদেহ বহনকারী গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ করতে থাকেন নেতাকর্মীরা। প্রায় ১৫ মিনিট আটকে থাকে মরদেহ বহনকারী গাড়ি। একপর্যায়ে গাড়িতে উঠে পড়েন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির। এরই মধ্যে প্রচার হয় মরদেহ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। বিক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে মাঠের পূর্ব দিক দিয়ে রওনা দেন মেয়র মোস্তফা।

এ সময় গাড়ির সামনে ও পেছনে হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিতে থাকে। মরদেহ বহনকারী গাড়ি এগোতে থাকে ধীরে ধীরে। মরদেহ ডিসির মোড় হয়ে যাওয়ার কথা থাকায় চেকপোস্ট পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে প্রশাসন। কিন্তু মোস্তফা নিজে গাড়ি চালিয়ে উল্টো পথ সিটি কর্পোরেশনের দিকে রওনা হন।

Advertisement

মরদেহের গাড়ি যখন সিটি কর্পোরেশনের সামনে ঠিক তখনই জিএম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমিও চেয়েছিলাম রংপুরে হোক ভাইয়ের সমাধি। রংপুরের মানুষের ভালোবাসার বিষয়টি আমি ভাবি রওশন এরশাদকে জানাই। তিনিও রংপুরে দাফনের অনুমতি দেন এবং কবরের পাশে তার জায়গা রাখার কথা বলেন। মুহূর্তেই তা ব্রেকিং নিউজে স্থান পায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটি বিশ্বাস করছিলেন না। সে কারণে এরশাদের মরদেহ বহনকারী গাড়ির সামনে পেছনে বিক্ষোভ চলতেই থাকে।’

পরে পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, শাপলা চত্বর, খামার মোড়, লালবাগ ও কলেজপাড়া দর্শনা হয়ে পল্লী নিবাসে গিয়ে মরদেহ বহনকারী গাড়ি পৌঁছায় বিকেলে সাড়ে ৪টায়। মাত্র ৪ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টারও বেশি।

এরই মধ্যে জিএম কাদের, মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা পল্লী নিবাসে চলে যান। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা শেষ করে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে পল্লী নিবাসেই সমাহিত করা হয় রংপুরের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পাওয়া তাদের এই প্রিয় নেতাকে। এর আগে গত ৮ জুলাই এরশাদকে রংপুরে সমাহিত করার দাবিতে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।

সিটি মেয়রের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী জাহিদ হোসেন লুসিড বলেন, মেয়র মোস্তফা যে মাটি ও মানুষের নেতা তা আর একবার প্রমাণিত হলো। তিনি না হলে এরশাদের মরদেহ রংপুরে দাফন করা সম্ভব হতো না। সিটি মেয়র নিজেই গাড়ি চালিয়ে কালেক্টরেট মাঠ থেকে পল্লী নিবাসে স্যারের মরদেহ নিয়ে যান।

জিতু কবির/এমবিআর/পিআর