৮৯ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের। তার মৃত্যুর সাথে সাথেই একটি প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতিটা একটু বোঝা দরকার।
Advertisement
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা ধাপ পেরিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন তখনকার সেনা প্রধান এইচ এম এরশাদ। ক্ষমতায় আসা এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে এরশাদ তার পূর্বসূরী জিয়াকে হুবহু অনুসরণ করেছিলেন। জিয়া যেমন ১৮ দফা দিয়ে রাজনীতিতে নেমেছিলেন। এরশাদ নেমেছিলেন ১৯ দফা নিয়ে। জিয়ার মতোই প্রথমে ফ্রন্ট-জোট ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টি গঠিত হয়।
বিএনপির মতো জাতীয় পার্টিও নানা দল থেকে আসা সুবিধাবাদী দলছুট নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি জগাখিচুড়ি রাজনৈতিক দল। ক্যান্টনমেন্ট থেকে গঠিত এ ধরনের রাজনৈতিক দলে আদর্শের বালাই খুব একটা থাকে না। তবুও আদর্শিক বিবেচনায় জাতীয় পার্টি বিএনপি ঘরানার। আসলে বাংলাদেশে রাজনীতির দুটি ধারা। একটি আওয়ামী লীগ, অপরটি আওয়ামী বিরোধী। ৭০এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী ধারার নেতৃত্বে ছিল মুসলিম লীগ। ৭৩এর নির্বাচনে জাসদ। আর ৭৯এর নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ বিরোধী ধারার নেতৃত্বে বিএনপি।
এরশাদ চেয়েছিলেন বিএনপিকে ধ্বংস করে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী বিরোধী ধারার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। কিন্তু সেটা হতে দেননি বেগম খালেদা জিয়া। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নেমে বিএনপির হাল ধরেন তিনি। বিএনপি ধ্বংস তো হয়ইনি, উল্টো এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া বিএনপিকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পোক্ত অবস্থানে নিয়ে যান।
Advertisement
এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে ৮৬ ও ৮৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু আমার বিবেচনায় জাতীয় পার্টি সবচেয়ে ভালো ফল করেছিল ৯১ সালের নির্বাচনে। পতনের পর দলের চেয়ারম্যান এরশাদ কারাগারে। দেশজুড়ে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত। সরকারও জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে। মাঠে নামলেই মার খায়। এমন অবস্থায় জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করে প্রবল উজানে সাঁতার কেটে ৩৫টি আসন লাভ করে।
কারাগারে থেকেও সদ্য ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ পাঁচটি আসনে জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এরপর নানান জোট মিলে আরো ৫টি নির্বাচনে অংশ নিলেও ৯১এর সাফল্য আর ছুঁতে পারেনি জাতীয় পার্টি। সর্বশেষ দুটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালে আসন পেয়েছিল ৩৪টি, আর এবার পেয়েছে ২০টি। এই সাফল্যও এসেছে আওয়ামী লীগের সাথে জোটের সুবাদে।
এককভাবে নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হতো। বিশেষ করে গত ১১ বছর ধরে সরকারি দলের সাথে থাকার কারণে জাতীয় পার্টির আবেদন ফুরিয়ে গেছে প্রায়। শেষ দুটি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও লোকে মজা করে ডাকে গৃহপালিত বিরোধী দল। গত সরকারে তো একই সঙ্গে বিরোধী দল এবং সরকারে থাকার বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল জাতীয় পার্টি।
আদর্শিক দৃঢ়তা না থাকায় জাতীয় পার্টি বরাবরই আবর্তিত হয়েছে সুবিধাবাদের বিবেচনায়। শুরুতেই জগাখিচুড়ি মার্কা দল গড়ায় দলে সবসময় নানান পন্থিদের ভিড় ছিল। কখনো এরশাদ বিএনপিপন্থিদের দ্বারা প্রভাবিত হতেন, কখনো আওয়ামী লীগ পন্থিদের দ্বারা। প্রকাশ্য জনসভার মঞ্চে জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে মারামারির ইতিহাসও আছে। এই টানাপড়েন এবং স্বার্থ বিবেচনায় বারবার ভেঙ্গেছে জাতীয় পার্টি। কতবার ভেঙ্গেছে, এটা রাজনৈতিক গবেষকরাও হিসাব মেলাতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
Advertisement
এই মুহুর্তেও জাতীয় পার্টি নামে চারটি সংগঠন আছে। মূল জাতীয় পার্টি তো আছেই; আছে, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জেপি), নাজিউর রহমান নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার ছেলে আন্দালিভ রহমান পার্থ। কাজী জাফর আহমেদের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি এখন চালান মোস্তফা জামাল হায়দার। ডা. মতিনও একটি জাতীয় পার্টি গঠন করেছিলেন। তবে সেটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই এখন।
জাতীয় পার্টির সবচেয়ে শক্তি এরশাদ। জাতীয় পার্টির সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও ছিলেন এরশাদই। আগেই বলেছি, জাতীয় পার্টির আদর্শিক দৃঢ়তা ছিল না। ব্যক্তি এরশাদকে ঘিরেই জাতীয় পার্টির বিবর্তন। সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় এসেছেন এবং নিষ্ঠুর কায়দায় আন্দোলন দমন করেছেন, এটা ঠিক। আবার এরশাদের নয় বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নও কম হয়নি। এরশাদ উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে চাইতেন। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নটা শুরু হয়েছিল এরশাদের হাত ধরেই। নানান প্রশাসনিক সংস্কারও করেছিলেন তিনি। আজকের উপজেলা পদ্ধতি এরশাতের প্রবর্তন করা।
এছাড়া এরশাদ আমলে প্রণীত স্বাস্থ্যনীতিও ব্যাপক প্রশংসিত। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এরশাদকে পাশে পেয়েছে সাধারণ মানুষ। আর রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পেরেছিলেন এরশাদ। তাই তার কিছু জনপ্রিয়তা আছে দেশজুড়ে। তাছাড়া স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর গত ২৯ বছরে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি যেভাবে দেশ চালিয়েছে, তাতে তুলনামূলক বিচারে এরশাদের পাপ অনেকটাই কমে গেছে। কেউ কেউ এমনও বলেন, এরশাদ আমলই ভালো ছিল।
সব মিলিয়ে ব্যক্তি এরশাদের একটা জনপ্রিয়তা ছিল। তাছাড়া প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুজন নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর বিপরীতে কারো কারো কাছে এরশাদ ভালো বিকল্প। কিন্তু গত ১১ বছর ধরে সরকারি দলের লেজুড় হিসেবে থাকতে থাকতে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছে। ব্যক্তি এরশাদের পক্ষে যে আর কিছু করা সম্ভব নয়, এটা বুঝে গিয়েছিলেন তার অনুসারীরাও। তাই বাস্তবে জাতীয় পার্টি এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু আঞ্চলিক দল।
এরশাদ যেমন জাতীয় পার্টির মূল শক্তি ছিলেন; তেমনি তার সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত বদল দলকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বিপাকে ফেলেছে। ৮২-৯০ পর্যন্ত এরশাদ বাংলাদেশ নিয়ে যা করেছেন, ৯০এর পর তাই করছেন জাতীয় পার্টি। এরশাদ এক বিরাট শিশু যেন; কখনো দেশ নিয়ে, কখনো দল নিয়ে খেলেছেন। তার কলমের খোঁচাই জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র। ফলে একটি রাজনৈতিক দলে হিসেবে কখনোই বিকশিত হতে পারেনি দলটি। বরাবরই থেকে গেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কোন্দল জর্জরিত একটি সংগঠন হিসেবে।
এখন প্রশ্ন হলো, এরশাদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টি কি নতুন করে সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? চাইলে সম্ভব। জাতীয় পার্টির সবচেয়ে বড় শক্তি এরশাদ, মৃত্যুর পর তার ভাবমূর্তি আরো শক্তিশালী হতে পারে। আর জাতীয় পার্টির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা যে এরশাদ, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই দুর্বলতা কেটে গেল। বিএনপির এখন যে দুরবস্থা, চাইলে জাতীয় পার্টি সে শূন্যতা পূরণ করতে পারে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সবার আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, সরকারি দলের লেজুড় ছাড়তে হবে। এতদিন তো মঞ্জুর হত্যা মামলায় ফাঁসির ভয় দেখিয়ে এরশাদকে পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন তো আর সে ভয় নেই। জাতীয় পার্টি ইচ্ছা করলে এখন সংসদে ও রাজপথে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারে। গত সংসদে রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে মুক্তি চেয়েছিলেন, এবার তা নিজেরাই পেতে পারেন।
তবে আমার ধারণা এসব কিছুই হবে না। জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সাংসদ ও নেতা সরকারি দলের আশ্রয় ছাড়তে চাইবেন না। সত্যিকার বিরোধী দল হওয়ার যে মর্যাদা সেটা তারা বুঝবেন বলে মনে হয় না। বিরোধী দল হওয়ার কষ্টের চেয়ে সরকারি দলে ছায়াতলে থেকে চুইয়ে পড়া মধুও তাদের কাছে অনেক বেশি মিষ্টি লাগবে।
এরশাদের উত্তরাধিকার জি এম কাদের তেমন কিছু করতে চাইলে দল ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশে মূল দলগুলো ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক। জাতীয় পার্টি তার ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং সবচেয়ে বড় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাই এরশাদের মৃত্যুর পর তার পরিবার থেকেই কেউ না কেউ দলের হাল ধরবে, এটাই স্বাভাবিক। এরশাদ তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে গেছেন।
কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে পার্টির নেতারা কতদিন জি এম কাদেরকে মানবেন, সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জি এম কাদের একদমই তার ভাইয়ের মত নন। তিনি সৎ, শিক্ষিত, ভদ্রলোক, নরম সরম মানুষ। জাতীয় পার্টিতে যে ধরনের মানুষের সমারোহ, তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মত যথেষ্ট নিম্নরুচির তিনি নন। জি এম কাদের যদি এই টাউটদের বাদ দিয়ে দলকে নতুন করে ঢেলে সাজান, তাহলেই কিছু সম্ভাবনা আছে।
জি এম কাদের না পারলে রওশন এরশাদকে দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু জাতীয় পার্টির মত একটি দলকে এগিয়ে নেয়ার মত ক্যারিশমা তার নেই। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ নিতান্তই একজন সাধাসিধা নারী। তারচেয়ে বড় কথা হলো এরশাদ বেঁচে থাকতে পার্টিতে তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন রওশন। আর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দেবেন রওশন, দলে এরশাদপন্থিরা এটা মানতে চাইবেন না। তাই জাতীয় পার্টি সামনে প্রথম ঝামেলা হবে নেতৃত্ব নিয়ে।
জাতীয় পার্টি যদি সরকারের লেজুড় ছেড়ে সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, জি এম কাদের যদি বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে পার্টিকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে সামনে এগুতে চান; তাহলে জাতীয় পার্টির সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত। আর যদি নেতৃত্ব নিয়ে নেতারা কামড়াকামড়িতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
এইচআর/এমকেএইচ