১৪ জুলাই সকাল পৌনে আটটায় মৃত্যুবরণ করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি ক্ষমতা জবরদখলকারী সামরিক শাসক, তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে প্রায় নয় বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত কোনো স্বৈরশাসক আর রাজনীতিতে ফিরতে পারে না। কিন্তু এরশাদ পেরেছেন এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর' থেকেই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলেন।
Advertisement
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। তাকে আন্দোলনের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। তার পুরো শাসনকাল জুড়েই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে অসংখ্য ছাত্র কর্মী জেল-জুলুম সহ্য করেছেন।
এরশাদের সময় তিনি একদিকে যেমন নিজের ক্ষমতার ভিত মজবুত করার জন্য দল ভাঙার রাজনীতি করেছেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি থেকে নিজের দলে লোক টেনেছেন, তেমনি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্যও গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি এবং যুগপৎ আন্দোলনের ধারা চালু হয়েছিল এরশাদের সময়েই। তিনি রাজনীতিতে ভাঙা এবং গড়া – দুই ক্ষেত্রেই ভূমিকা রেখেছেন।
এরশাদের শাসনকাল নিয়ে নিন্দা-সমালেচনা বেশি হলেও তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ভালো কাজ কিছু করেননি, তা কিন্তু নয়। তার আমলে দেশের রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। রাজধানীর পান্থপথসহ বেশ কিছু রাস্তা তৈরি কিংবা সম্প্রসারিত হয়েছে তার সময়ে। তার শাসন আমলে ঘুষ-দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। তিনি নিজেও আর্থিক এবং নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়েছেন। তিনি শাসক হিসেবে ‘বিশ্ববেহায়া' অভিধা পেয়েছেন।
Advertisement
সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করে তিনি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ তথা অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে দিয়েছেন। তার সময়ে অনেক ক্ষেত্রে যে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তবে উপজেলা ব্যবস্থাসহ কিছু ‘প্রগতিমুখী' পদক্ষেপও তিনি নিয়েছেন। রাজনীতিতে এরশাদের সাফল্য এটাই যে, তার বিরুদ্ধ যারা রাজপথে আন্দোলন করেছে, তারা ক্ষমতায় এসেও তার প্রবর্তিত নীতি-পদ্ধতির পরিবর্তন করতে পারেনি। রাষ্ট্র ধর্ম এখনও বহাল। উপজেলা ব্যবস্থা আর বাতিলের কথা কেউ ভাবে না।
এরশাদের মৃত্যুর পর সাংবাদিক জ. ই. মামুন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন : ‘এরশাদ এমন এক চরিত্র, বাংলাদেশের রাজনীতি যাকে গিলতে পারেনি, উগরাতেও পারেনি'। আমি এই মতের পক্ষে। বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতি এরশাদকে গ্রহণ করেনি, আবার বর্জনও করেনি। তাই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েও তিনি আমৃত্যু রাজনীতিতে ভূমিকা রেখে যেতে পারলেন। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি জেলে গেছেন। জেল থেকে এক সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে নির্বাচন করে রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে তিনি বিজয়ী হয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকার টিকেট পেয়ে যান। তার বিরুদ্ধ ৪২টি মামলা হয়। কিন্তু রাজনীতিতে তাকে ‘অপ্রাসঙ্গিক' করা যায়নি।
দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসার পর প্রতিটি নির্বাচনে এরশাদ যেমন ব্যক্তিগতভাবে জয়লাভ করেছেন, তেমনি তার দলও দেশের তৃতীয় বড় রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এরশাদ আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেটা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হতে পেরেছিলেন। তাকে নিয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ – দুই দলই টানাটানি করেছে। তিনি ঝু্ঁকেছেন আওয়ামী লীগের দিকে। বিএনপিকে তার মিত্র হিসেবে অনির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে।
আবার আওয়ামী লীগও এরশাদকে ‘কনসেশন’ দেওয়া লাভজনক বিবেচনা করেছে। ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ ছাড়াও ক্ষমতার রাজনীতির আরো কিছু সমীকরণ থাকে। জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুটি চালাচালির বিষয়টি বিবেচনা করতে হয় ক্ষমতায় যেতে হলে। এসব করেই আওয়ামী লীগ এরশাদের মতো রাজনীতির পচা মালকেও সঙ্গে রেখেছে।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে মন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেছেন এরশাদ। তিনি সরকার প্রধান হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে পারেননি। মারা গেলেন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করেছেন। এটা রাষ্ট্রাচার। এই যে মৃত্যতেও তিনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে শোক ও সমবেদনা আদায় করতে পারলেন, এটাই বা কম কি!
এম আব্দুল করিম নামের আমার এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছেন : ‘এক সফল ক্যারিশমেটিক স্বৈরাচারের স্বাভাবিক মৃত্যু'। আপাতত এরশাদকে নিয়ে এরচেয়ে ভালো বাক্য আর কিছু হতে পারে না। এরশাদ চলে গেলেন। ক্ষমতা দখল করে এবং ক্ষমতাচ্যুত হয়েও রাজনীতিতে তিনি যেসব স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছেন তা আমাদের আরো বহুদিন বহন করে চলতে হবে।লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম