নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যু আমাদের আবারও জানিয়ে দিয়ে গেল আমরা এখনও এক অসভ্য ও বর্বর সমাজে বসবাস করছি। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মতো সিরিয়াস কিছু ঘটনা ঘটলেই কেবল আমরা নড়েচড়ে বসি। আমরা প্রতিবাদ করি, বিচার চাই, প্রতিকার চাই। কিন্তু এই রকম ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিদিনই ঘটছে। রাফির মৃত্যুর পও আরও বেশকিছু ধর্ষণের ঘটনা ইতোমধ্যে দেশে ঘটেছে। আমরা সবসময় ধর্ষণের কারণ খুঁজি। ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজি। এসব করতে গিয়ে ধর্ষকের সাজাটাই আর হয় না। ফলশ্রুতিতে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনার মাত্রা কোনোভাবেই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
Advertisement
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত ১৮ বছরে (২০০১-২০১৮) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩,৬৩৮ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬,৫৭০ এবং ৬,৯২৭ জন। এছাড়াও আরও ১৪১ জন নাম-পরিচয়হীন নারী ধর্ষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, ২,৫২৯ জন নারী ও শিশু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর ১৪৬৭ জনকে (নারী-৪৭৩, শিশু-৩৫৮ এবং নাম-পরিচয়হীন নারী- ১১) হত্যা করা হয়। অপমান সহ্য করতে না পেরে এবং বিচার না পেয়ে ১৫৪ জন নারী ও শিশু আত্মহত্যা করেছেন। এই ১৮ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও ৯০টির মতো ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিবছর গড়ে ৭৮৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছেন। এই সময়কার সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে ২০০২ এবং ২০০৩ সালে এবং ধর্ষিতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১,৩৫০ এবং ১,৩৩৬ জন। এখানে উল্লেখ্য যে, বিগত সাড়ে চার মাসেই (জানুয়ারি-এপ্রিল ২০১৯) ৩৪৬ শিশু ধর্ষিত হয়েছে এবং আরও ৪৭০ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
প্রতিবছর এত সংখ্যক নারী ও শিশু ধর্ষিত হওয়ার কারণে বারবার একটি প্রশ্নই মনে ঘুরপাক খাচ্ছে রাষ্ট্র কি ধর্ষকের? বাংলাদেশকে কতিপয় মানুষ ধর্ষকের রাষ্ট্র পরিণত করছে। অথচ ধর্ষকের বিচার নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ষক কি আইনের ঊর্ধ্বে? ধর্ষণ কীভাবে এত সহজ বিষয়ে পরিণত হলো? চাইলেই বাসের একজন হেল্পার, কন্ডাক্টর এবং ড্রাইভার একটি মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারেন। চাইলেই একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি একটি মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারেন। চাইলেই একজন শিক্ষক, মাওলানা, ইমাম কিংবা মৌলভী ধর্ষণ করতে পারেন। আমাদের বাবা-মায়েরা কি মেয়েদের কষ্ট করে বড় করেন অন্যের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার জন্য? ধর্ষকের এত জোর কোথায়? ধর্ষণের পর কেন তারা সহজে জামিন পায়? পুলিশ কেন ধর্ষকের মামলা নিতে গড়িমসি করে? এর দায় কি সরকারের ওপর বর্তায় না?
Advertisement
দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। বর্তমান সরকার ত্বরিত গতিতে কিছু পদক্ষেপ নিলেও ধর্ষণ কিছুতেই থামছে না। উল্টো ধর্ষিত নারী ও শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এই ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে যুক্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম কিংবা মুয়াজ্জিন। বিশেষ করে মাদরাসার শিক্ষকদের দ্বারা যৌন হয়রানি এবং শিশু বলৎকারের ঘটনা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাদের কাছে থেকে সমাজ অপরাধ নির্মূলে ভূমিকা প্রত্যাশা করে তারাই যদি ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক কাজে লিপ্ত হয় তাহলে আমাদের হতাশা বাড়বেই, কমবে না।
ধর্ষণের পর সবচেয়ে ভয়ংকর যে ব্যাপারটি ঘটছে তা হলো, ধর্মের অপব্যাখ্যায় নারীর পোশাককে দায়ী করে ধর্ষকের ধর্ষণকেই জায়েজ করার একটি অপকৌশল বেছে নেয়া। ধর্ম কি কাউকে বলেছে যে, নারীর পোশাক খারাপ হলেই তাকে ধর্ষণ করতে হবে? ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী এই কাজটি আমাদের সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলদের একটি অংশ করে থাকেন। এর সঙ্গে জোরালোভাবে যুক্ত হলো কতিপয় নামধারী ধর্মব্যবসায়ী আলেম।
ধর্ষণের নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। তবে আমার দৃষ্টিতে ধর্ষণের কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, পুরুষের বিকৃত যৌনচিন্তা। কিছু পুরুষ মেয়ে দেখলেই শারীরিক সম্পর্কের চিন্তায় মনে মনে বিভোর হয়ে পড়ে। এরাই মূলত ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হয়। এদের চিন্তায়, চেতনায়, মননে এবং মগজে বিকৃত যৌন লালসার চর্চা হয়।
এছাড়াও এক শ্রেণির ধর্ষক আছে যারা নানা কায়দায় যুক্তিতর্ক দিয়ে ধর্ষকের ধর্ষণকে জায়েজ করে। এ রকম ধর্ষকশ্রেণির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে নুসরাতের ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহর উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “মেয়েটা কিন্তু জোস ছিল। মালটা ধর্ষণ করার মতোই ছিল।’’ সমাজে এ রকম ধর্ষকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ধর্ষণকে কেবল নারীর সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ককেই বোঝালেই হবে না। যে মানুষটি একজন মেয়ে দেখলেই অন্তরে ধর্ষণের স্বপ্ন লালন করেন আমার দৃষ্টিতে সেও ধর্ষক। সে অন্তরে ধর্ষণের মতো জঘন্য চিন্তা লালন করে।
Advertisement
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ধর্ষণ না কমার কারণ। দেশে এত ধর্ষণের পরও কয়টির বিচার হয়েছে? যদি ধর্ষণের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে হতো তাহলে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসতো।
এছাড়াও আরও একটি বিষয় হলো, ধর্ষকের বিচার না হওয়ার জন্য আমরাও দায়ী। আমাদের অন্যতম একটি বাজে প্রবণতা হচ্ছে, ধর্ষণের পর অপরাধীর অপরাধের বিচার না চেয়ে তাকে বিভিন্ন দল এবং গোত্রে ভাগ করে থাকি। ধর্ষককে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত কিংবা জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা ও কর্মী হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকি। এতে দোষারোপের দোলাচলে ধর্ষক পার পেয়ে যায়। এটা আরও বড় ধরনের অন্যায় বলে মনে হয় আমার কাছে।
নুসরাতের মতো অসংখ্য মেয়ে ধর্ষিত হওয়া এবং হত্যার দায় রাষ্ট্রের। সর্বোপরি এর দায় প্রতিটি সরকারের এবং রাজনৈতিক দলের। সরকারি কিংবা বিরোধী- কোনো দলই নারীর অধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেনি। ভাবতে কষ্ট হয় এই জন্য যে, ১৯৯১ সাল থেকে এদেশে দুজন নারী দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। দুই সরকারের সময়েই কিছু নারী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারী থেকে যদি নারীর সুরক্ষা না হয় তাহলে নারীর সুরক্ষা কীভাবে আসবে? নারীরা যদি নারীর জন্য নারীবান্ধব আইনের বাস্তবায়ন না করেন তাহলে নারীর জন্য কে লড়বে?
প্রতিদিন একের পর নারী ও শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। এই ধর্ষকদের বিচারে সরকারের এত অনীহা বোধগম্য নয়? ধর্ষকদের দ্বারা কি দল ও দেশ চলে? যদি তা না হয় তাহলে ধর্ষকদের বাঁচার অধিকার এবং আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার কেন থাকবে? ধর্ষক ধর্ষকই। তাকে দলীয় কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ে হালকা বা ভারী করার সুযোগ নেই। যারা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করেন তারাও অন্তরে ধর্ষকের কু-প্রবৃত্তি ধারণ করেন। তাদেরকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো জরুরি। ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত বিচারের বাইরে গিয়ে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
ধর্ষকের কোনো দল নেই, ধর্ম নেই, দেশ নেই।
বিএ/এইচআর/জেআইএম