ঘরের মাঠে ৪০ বছর পর বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে ইংল্যান্ড। ২৪ ঘণ্টা পর ক্রিকেট ‘মক্কা’ লর্ডসে নিউজিল্যান্ডের সাথে সেই অনেক প্রত্যাশার ফাইনাল।
Advertisement
মনে হচ্ছিল, লন্ডন শহরজুড়ে বুঝি সাজ সাজ রব পড়ে যাবে। ঘরে ঘরে উৎসবের পসরা সাজবে। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রেঁস্তোরা-বার ও পাবগুলোয় বুঝি অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য আর সাড়া পড়ে যাবে। শুনে অবাক হবেন, ওসবের ছিঁটেফোটাও নেই লন্ডন শহরে।
যে পাতাল রেলে চড়লে লন্ডন শহরের মানুষের নাড়ীর আর হাড়ির খবরও মেলে, লন্ডনবাসীর ইচ্ছা, ভালো লাগা, রাগ-বিরাগের খবর আপনা আপনি বোঝা যায়, সেই পাতাল রেলে চেপে ডিসট্রিক্ট লাইন, সেন্ট্রাল লাইন, জুুবিলি লাইন ও হ্যামারস্মিথ লাইনে পুরো লন্ডন শহর ঘুরেও বোঝার উপায় নেই, রাত পোহালে এই শহরে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল হচ্ছে। তাতে ফেবারিটের তকমা নিয়ে বিশ্বসেরা হওয়ার লক্ষ্যে মাঠে নামবে ইয়ান মরগ্যানের ইংলিশ বাহিনী।
ক্রিকেটের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে লন্ডনবাসীর এমন নিরুৎসাহের কথা শুনে নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে না। হওয়ার কথাও নয়। বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট প্রেম, অনুরাগ, ভালোবাসা আর উৎসাহ-উদ্দীপনা এখন আসলে অন্য মাত্রায় চলে গেছে।
Advertisement
একবার ভাবুন তো, কালকের বিশ্বকাপ ফাইনালটা রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে হচ্ছে! আজ ঢাকা শহরের কি অবস্থা থাকতো! এ বিশ্বকাপ ফাইনালই থাকতো 'টক অব দ্য কান্ট্রি'। সবার চিন্তাভাবনা আর মুখে থাকতো একটাই টপিক।
প্রিয় জাতীয় দল কেমন করবে, শেষ হাসি হাসবে কিনা- তা নিয়ে রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জনে মুখরিত থাকতো রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ। ফাইনালের আগের দিন মাশরাফি, সাকিবদের প্র্যাকটিস থাকলে শুধু তাদের টিম বাসের পিছন পিছন ছুটে আসতো হাজারো কিশোর-যুবা। অন্তত তিন-চার হাজার ক্রিকেটপাগল মানুষের কলতানে মুখর থাকতো শেরেবাংলার আশপাশ।
কিন্তু লন্ডনে তার কিছুই নেই। রাস্তায় বের হলে বোঝার উপায় নেই পরদিন এ শহরে বিশ্ব ক্রিকেটের মহাযজ্ঞ হচ্ছে। এমনকি যে মাঠে খেলা, সেই লর্ডসে আজ (শনিবার) সকালে ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিস দেখতে একজন বাড়তি উৎসাহী ইংলিশ সমর্থকের দেখা মেলেনি।
লন্ডনে লর্ডসের সবচেয়ে কাছে পাতাল রেলস্টেশন হলো সেন্ট জন্স উড, সেখান থেকে ১ হাজার গজের মতো পথ হাঁটলেই লর্ডস। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় গলায় বিশ্বকাপের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ঝুলিয়ে একসঙ্গে আমরা চারজন বাংলাদেশি সাংবাদিক নামলাম, তা দেখে সোৎসাহে একজনও জিজ্ঞেস করলেন না, ‘ওহ, আপনারা বিশ্বকাপ কভার করতে এসেছেন? আমাদের দল তো বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে। কাল ফাইনাল। আমরা মুখিয়ে আছি তা দেখতে। প্রিয় জাতীয় দলকে প্রথমবার ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হতে দেখতে।’
Advertisement
অমন কথা বলা দূরের কথা, সেন্ট জন্স উড থেকে লর্ডসের মূল প্রবেশ পথের বাইরে হাঁটা পথেও সেই একই অবস্থা। যে যার মতো ছুটছেন। বেশির ভাগই পায়ে হেঁটে। কেউবা প্রাইভেট কারে কিংবা ট্যাক্সিতে চেপে। আর না হয় সিটি সার্ভিস বাসে।
সেন্ট জন্স উড স্টেশনে নেমে একজন ইংলিশ সমর্থককেও পাওয়া গেল না, যার চোখে-মুখে অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য। ধারণা ছিল লর্ডসের ঢোকার পথেই বুঝি দেখা মিলবে ‘বার্মি আর্মিদের।’ সে আশায়ও গুড়ে বালি।
আসলে ক্রিকেট এখন আর ইংলিশদের প্রথম পছন্দ নয়। ফুটবল সেই জায়গা নিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। ক্রিকেট এখন মাঝ বয়সীদের অবসর বিনোদন। নতুন প্রজন্ম মেতে আছে ইংলিশ ক্লাব ফুটবল নিয়ে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, চেলসি, টটেনহ্যাম, আর্সেনালই তাদের ধ্যান-জ্ঞান।
তার প্রমাণ নিজ চোখেই দেখেছি। গত মাসে ইউরোপিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের লিভারপুল আর টটেনহামের ফাইনাল নিয়ে কি উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল লন্ডনবাসীর। ছোট-বড় বার-পাব তথা পানশালায় জায়ান্ট স্ক্রিন লাগানো হয়েছিল। ছেলে বুড়ো, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী আর মাঝ বয়সী সবাই মিলে মিশে হইচই করে পানশালায় বসে চিল্ড বিয়ার আর ওয়াইন, হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে খেলা দেখতে বসেছেন।
কথা হলো লর্ডসের প্রেসবক্স ও মিডিয়া প্রধান সমন্বয়কারী ট্রেসি ও তার স্বামী টনির সাথে। প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম- রাত পোহালেই বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনাল। কই তা নিয়ে তো তোমাদের দেশের মানুষের তেমন উৎসাহ-আগ্রহ নেই? এমনটা কেন?
ট্রেসির জবাব, ‘আসলে ক্রিকেট নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের আকর্ষণ তুলনামূলক কম। এটা বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনাল হলে বুঝতে ইংলিশদের ফুটবলপ্রেম কত প্রবল!’
টনির ব্যাখ্যা ভিন্ন, ‘আসলে জাতিগতভাবে ইংলিশরা একটু অন্যরকম। আবেগ-উচ্ছ্বাস, বাহ্যিক প্রাণচাঞ্চল্য, হইচই, শোরগোল করে কোনো উৎসব-পার্বন উদযাপনের রীতিই এদেশে ও জাতির মাঝে কম। তারা আবেগ-উচ্ছ্বাসকে চেপে রেখে আনন্দ করে। উৎসবেও যতটা পরিমিতিবোধ রাখা যায়, ততটাই রাখে।’
বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে সাত সপ্তাহ যুক্তরাজ্যর এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে টনির কথাটি সত্যি বলেই মনে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মতো উচ্ছ্বাস-উল্লাস, সশব্দে হইচই শোরগোল করে আনন্দ প্রকাশ করে না ব্রিটিশরা। সব কিছুতেই একটা পরিমিতিবোধ কাজ করে।
একটা উদাহরণ দেখলে আরও স্পষ্ট হবে সব। একবার ভাবুন তো, এই যে ক্রিকেটের মহাযজ্ঞ হলো ইংল্যান্ডে, তাদের প্রাইভেট চ্যানেলগুলোয় সে খেলা প্রচার হয়নি। সাধারণ মানুষ ঘরে বসে বিশ্বকাপও দেখতে পারেননি।
সেটা স্কাই টিভিতে দেখানো হয়েছে, যা শতকরা ৯৯ ভাগ সাধারণ বাড়িতে নেই। এমনকি ফাইভ স্টার হোটেল ছাড়া কোনো হোটেলে রুম ভাড়া করেও বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ ছিল না। কারণ ‘স্কাই স্পোর্টস’ পে চ্যানেল। সে চ্যানেল দেখতে অনেক বেশি টাকা লাগে, যা বেশিরভাগ ইংলিশ পরিবারই অত টাকা খরচ করে দেখে না।
তবে আশার কথা, ফাইনালের আগে সেই পে-চ্যানেলের সাথে কথা বলে স্টার স্পোর্টস খেলা দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তার মানে এখন ঘরে বসে কালকের ফাইনাল দেখতে পাবেন ইংলিশরা।
কালকের ফাইনালের আগে লন্ডনের উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো খবরই নেই। উল্লেখযোগ্য খবর বলতে ওই পে-চ্যানেলটা ফাইনালের জন্য সর্বজনীন করে দেয়াই।
এআরবি/এমএমআর/পিআর