ধর্ম ধর্ষণের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড বিরুদ্ধে। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষকরা ধর্ষণ করছে। সবাই নয়, তবে করছে অনেকেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধর্ষণ করেই যাচ্ছে। করেই চলছে ধর্ষণ। যখন ফাঁস হচ্ছে ঘটনা, খবরে আসছে তখনই কেবল জানা যাচ্ছে; তার আগে নয়।
Advertisement
আমরা যাদের শিক্ষক বলছি, শিক্ষক বলে মনে করছি, এরা আসলে কেউ শিক্ষক নয়। শিক্ষকই নয়। মাদরাসা, ‘মাদরাসাতো আরো পরের বিষয়। শিক্ষক তো অভিভাবক, শিক্ষার্থীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সেই শিক্ষকই যখন যৌন নিপীড়ক, যৌন হেনস্তাকারী, ধর্ষণকারী তখন সে কীভাবে, কী করে আর শিক্ষক থাকেন? তাদের শিক্ষক না বলে ‘তথাকথিত’ শিক্ষক বলা ভালো। দেখতে মানুষের মতো হলেই কি আর সবাই মানুষ হয়ে গেলো!
প্রশ্ন উঠতে পারে, মাদরাসায় যে ‘তথাকথিত’ শিক্ষকরা ধর্ষণ করে যাচ্ছে তারা কারা? এরা কি তবে বহিরাগত? না, তা নয়। এরা মাদরাসা শিক্ষায় বড় হওয়া, বেড়ে ওঠা। কিন্তু যে শিক্ষায় তারা বেড়ে উঠেছে, বড় হয়েছে সেটা ভুল শিক্ষা। প্রকৃত ধর্ম শিক্ষাটাও পায়নি তারা। যদি পেতো তবে এমনতো হওয়ার কথা নয়। ইসলামের কোথাও নেই, কোরআনের কোথাও নেই নারীকে নির্যাতন করো, নিপীড়ন করো, হেনস্তা করো। বরং আরবে যখন নারীরা নির্যাতিত, নিপীড়িত তখন ইসলামই বলেছে, নারীরা মানুষ, তাদেরও আছে অধিকার। নারীদের যখন কোনো অধিকারই ছিল না মানুষ হিসেবে, ছিল কেবল দুর্ভোগ আর দুরবস্থার জীবন, তখন ইসলাম নারীকে মুক্তি দিতে চেয়েছে। নাজিল হয়েছে ‘সুরা আন নিসা’। শুধু তাই নয়, কোরআনের আরও অনেক সুরায়, আয়াতে নারীদের সম্মান ও অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এই কথিত শিক্ষকদের আসলে ধর্মে বিশ্বাস নেই, ইসলামে বিশ্বাস নেই। যদি থাকতো তাহলে কি করে যৌন নিপীড়ন করে যেতে পারে দিনের পর দিন, অন্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে! এরা ধর্মের গ্রন্থ নয়, ধর্মের নামে অপাঠ্য, আবর্জনা পড়ে পড়ে বড় হয়েছে। হবে না কেন, বেশিরভাগ মাদরাসায় ভালো তাফসির নেই, তরজমা নেই, ইসলাম নিয়ে উন্নত আলোচনা নেই। মাদরাসা মক্তবে ভরে আছে ‘নারীর পর্দা’, ‘বেহেশতি নারী’, ‘বেহেশতি হুর’, ‘ইসলামি দাম্পত্য’, ‘লজ্জাতুন্নেসার ওয়াজ’, ‘মহিলাদের ওয়াজ’- এমন সব বইয়ে।
Advertisement
অন্য কোনো বইয়ের অনুপ্রবেশ এখানে প্রায় নেই। ‘এসব বই’ মূলত কোন ধর্মীয় বই নয়, ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকেও নয়। সমাজ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, সে আলোকে, উদ্দেশ্যে বইগুলো লেখা। যার একমাত্র লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাজার থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়া। এসব বইয়ে নারী ভোগ্য বস্তু আর পুরুষের সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
মাদরাসার মেয়েরাও এসব আবর্জনা পড়ে পড়ে নিজেকে একটা যৌনবস্তু ভাবতে শেখে। মাদরাসার ক’জন মেয়ে আরবি বুঝে পড়ে, অনুবাদ বোঝে? বুঝে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, বাণী, আদর্শ আর উদ্দেশ্য?
ইসলাম তো অনেক উদার, মানবিক। সত্য আর ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সুযোগ কোথায় সেখানে জোর-জুলুমের? কোথাও নেই। বরং ইসলামে নারী ও পুরুষের দায়িত্বশীল সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, পর্দা নারীর জন্য, পুরুষের জন্যও। এমনকি বিবাহবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক, বহুগামিতা আর পরকীয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মাদরাসায় মেয়েদের যেভাবে রাখা হয়, যে পরিবেশে প্রতিবেশে বেড়ে ওঠে মেয়েরা, সেখানে পুরুষ প্রভু আর মেয়েরা প্রভুদাসী এমন ধারণায়ই তো বড় হয়। মাদরাসার প্রায় প্রতিটি মেয়ে নিজেকে অপরাধী ভাবে, মনে করে মেয়ে মানেই পাপের বস্তু। তাকে আড়ালে থাকতে হবে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে হবে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকবে সে। সামনে এলেই বিপত্তি, গুনাহের ভাগীদার সে।
Advertisement
ফলে এ মেয়েদের ‘পুরুষ প্রভু’ আর নিজেরা ‘পাপী-অপরাধী’ মানসিকতার সুযোগ নেয় এই ধর্ষকরা। পৃথিবীর বহু দেশের জেলখানায় যেমন জেলবাসী মেয়েরা, নারীরা প্রায়শই যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হন; তেমন অনেকটা।
হিজাব-জোব্বা পরে ছোটাছুটি, ওয়াজের ক্যাসেট শোনা আর জেহাদি বই বিক্রি ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’, তা প্রকৃত ইসলাম নয়। এর নেপথ্যের কারিগর পুঁজিবাদ আর ক্ষমতা। বেশির ভাগ মাদরাসাও গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক লক্ষ্য উদ্দেশ্যেই। ইসলামের প্রকৃত ঔদার্য, মানবিকতার শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগও প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে সেখানের যে মৌলানা তাদের অনেকেই দাড়ি, টুপি আলখেল্লা পরলেও ভেতরে ভেতরে পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, কেউ কেউ বিকৃতকাম।
সব মাদরাসা শিক্ষকের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, ধর্ষক আসলে ধর্ষকই, বিভিন্ন মাদরাসায় যে কুৎসিত, অমানুষ আর কুলাঙ্গাররা ধর্ষণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে মৌলানা, মৌলবীদেরই সোচ্ছার হওয়া উচিত। প্রতিবাদ করা উচিত কঠোরভাবে। কেননা ধর্মীয় শিক্ষকের মুখোশ পরা এসব ধর্ষকরা ক্ষতি করছে প্রকৃত মানবিক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, ইসলামের; এমনকি ধর্মেরও।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর