রাজধানী ঢাকার উত্তর থেকে দক্ষিণ- মানুষ অতিষ্ঠ ক্ষুদ্রের অত্যাচারে। এই ক্ষুদ্র প্রাণী হল মশা। ঢাকা মসজিদের নগরী, ঢাকা রিকশার নগরী – এমন অসংখ্য পরিচয় আছে। কিন্তু সব পরিচয়কে ছাপিয়ে ঢাকার বড় পরিচয় ‘ঢাকা মশার নগরী’। আমাদের শক্তিশালী প্রশাসন, আমাদের স্মার্ট সিটি করর্পোরেশনদ্বয় পরাজিত এই মশার কাছে।
Advertisement
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সিটি কর্পোরেশন, সচিবালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি প্রেসক্লাব বা শাহবাগের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে। এ বছর কত জন আক্রান্ত, কত জন মারা গিয়েছেন ডেঙ্গুতে, তা নিয়ে তর্ক করে তারা যাদের কাজটা ছিল মশা মারা, নগরীর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা। তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানেন কি পরিস্থিতি তারা মোকাবেলা করছেন। যাদের স্বজন মারা গেছে তারা হারানোর ব্যথা বোঝেন, যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারা জ্বালা সইছেন। দায়িত্ব পালন ঠিকমত না করে কোন কিছুকে অস্বীকার করা বা না দেখার চেষ্টা করা সমস্যার সমাধানে কোন ভূমিকা না রেখে তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে, সেকথা গদিনশিনরা কখনও বুঝতে চান না।
নানা ধরনের হিসাব আসছে। তবু পরিসংখ্যান ছাড়াই বোধহয় এটা বলা চলে যে, এত দ্রুত, ব্যাপক এবং ঝুঁকিপূর্ণ সংক্রমণ আমরা অনেকদিন পর দেখছি। কী করে ঢাকায় এ বছর এমন ভয়ানক আকার নিল ডেঙ্গু? প্রথমেই বলা হবে মানুষের অজ্ঞানতাই মূলত এই সমস্যার জন্য দায়ী।
Advertisement
একটা কথা ঠিক যে, আমরা সাধারণ মানুষরা, বিশেষত শিক্ষিত মানুষরা ডেঙ্গু বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করি। টবে বা ফুলদানিতে পানি জমিয়ে রাখা, এসির পানি কোথায় গিয়ে জমছে, কোন ফেলে দেয়া পাত্রে পানি জমে আছে কিনা, ছাদে বা বাগানে জমা পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে কিনা সেই খেয়াল আমাদের নেই। আর এতে করে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি। এগুলো সবই ঠিক। কিন্তু শুধু সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে এটা হয়েছে তা বলা যাবেনা। জমা পানি সবচেয়ে বড় আয়োজন করে রেখেছে শহর জুড়ে উন্নয়ন কাজের নামে ঠিকাদাররা নানা জায়গায় নির্মাণ সামগ্রী স্তুপ করে রেখে। এগুলো দেখবার বা নজরদারি করার কেউ কি আছে?
ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া মূলত শহুরে অসুখ। নগরায়ণের ফলে শৌচাগার ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে শহরের আনাচে-কানাচে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে দায়িত্ব কার বেশি? জনগণের না সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের?
ঢাকায় এখন দুটি সিটি কর্পোরেশন। এদের অনেক কাজ। সড়ক মেরামত ও সংস্কার থেকে এর ব্যবস্থাপনা, শহরে পরিবহন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নানা ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, জলাবদ্ধতা দূর করা ইত্যাদি। এসবগুলোর জন্য তাকে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা বিভাগের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। কিন্তু আরও দুটি মৌলিক কাজ একান্তই সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব।
মশা মারা আর আবর্জনা পরিষ্কার করা। আমরা দেখছি এই দুটি কাজেই কর্পোরেশনের সীমাহীন ব্যর্থতা। সময় হয়েছে হয়তো এটা ভাববার যে - সিটি কর্পোরেশন বাকি সব কাজ থেকে সরে গিয়ে এই দুটি মৌলিক কাজেই মনোনিবেশ করুক। মেয়রদ্বয় আর কাউন্সিলরদের আর কোন কাজ নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে যে উষ্ণতা বাড়ছে, তাতে ২০৮০ সালের মধ্যে ১.৫-৩.৫ বিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকবে। ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ধরা পড়তে পড়তে যেহেতু অনেক সময় দেরি হয়ে যায়, আবার সারাক্ষণ মশা থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা সাধারণ জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, তাই প্রতিরোধের দিকেই নজর দেয়া উচিত। বনায়ন ছাড়া আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্ভব নয়। নগরায়ণ দরকার তবে যত্রতত্র নয়। আজ ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গু হচ্ছে কাল গ্রামে গ্রামে হবে। শহর এলাকায় নিয়মিত মশা নিধন কর্মসূচি চলে। আবার কিছু কিছু জায়গায় তা অনিয়মিত।
এলাকায় এলাকায় লোকজন সচেতনভাবে নর্দমা পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করলে, আটকে থাকা পানির স্থানে বেশি করে পানিপ্রবাহ দেয়ার চেষ্টা করলে মশার জীবনচক্র ব্যাহত হবে। কিন্তু মূল দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। একটা কথা বলবেই শহরে মশাবাহিত রোগের মোকাবিলায় অবকাঠামো দুর্বল, প্রয়োজনীয় অর্থ ও কর্মীর অভাব রয়েছে। সত্যি বলতে কি দুর্বলতা প্রতিফলিত হয় বরাদ্দ অর্থের খরচে অক্ষমতাতেও। আসল কারণ অবহেলা। এ হল জনস্বাস্থ্যোর প্রতি পাইকারী অবহেলা। প্রধানমন্ত্রী একটু নজর দিতে পারেন কেন এই বিষয়টি এমন করে অবহেলা করা হয়েছে? কেন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে সময় ও সুযোগ দেয়া হয়েছে?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম