সপ্তাহজুড়ে দেশের গণমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা। শুধু সপ্তাহ নয়, এ আলোচনা সারা বছরের; গত এক দশকের। সমস্যা নিরসনে উদ্যোগেরও শেষ নেই। কিন্তু সব আলোচনা-উদ্যোগের বাইরেই থেকে গেছে এক ঘুটঘুটে আঁধার। টানা বর্ষণে গত পাঁচদিন ধরে পানিতে ডুবে আছে জেলার অনেক গ্রাম। ডুবেছে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। নদীর ভাঙনে বিলীন গয়ে গেছে অন্তত ৫০টি বাড়িঘর।
Advertisement
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, ইছামাতি, ডাবুয়া, সর্তা, ও শঙ্খ নদীতে পানি প্রবাহ বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার উপরে। তলিয়ে গেছে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, বাশঁখালী ও বোয়ালখালী উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি ও নিম্নাঞ্চল। কর্ণফুলী, শঙ্খ ও হালদা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে নদী পাড়ের অন্তত ৫০টি বাড়িঘর।
কর্ণফুলী নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বোয়ালখালী উপজেলার বিস্তির্ণ এলাকা
বোয়ালখালী উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক পূজন সেন জাগো নিউজকে জানান, আষাঢ়ের শেষে গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে পানি প্রবাহ বেড়েছে কর্ণফুলী নদীতে। ঢল নেমেছে ভান্ডালজুড়ি খালে। এতে বোয়ালখালী উপজেলার জ্যৈষ্ঠপুরার ভান্ডালজুড়ি খালে সাতটি বসতসঘর তলিয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে আরও ১০ পরিবারের বসতঘর। এ ছাড়া টানা বৃষ্টির ফলে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, ডুবেছে ফসলি জমি।
Advertisement
শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম বলেন, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ভান্ডালজুড়ি খালে এ পর্যন্ত সাতটি পরিবারের বসতঘর তলিয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে আরও ১০টি পরিবারের বসতঘর। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে এবং ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হচ্ছে। উপজেলার পাহাড়ি এলাকাতে দুর্ভোগে আছেন বাসিন্দারা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত ) মো. একরামুল ছিদ্দিক বলেন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পাহাড় ও নদী পাড়ের মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বোয়ালখালী উপজেলার বিস্তির্ণ এলাকা
পটিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের টানা বর্ষণে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বেশকিছু বসতঘর। পানিতে ভেসে গেছে প্রায় ২০০ পুকুরের মাছ। প্লাবিত হয়েছে উপজেলার কেলিশহর, হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা, ভাটিখাইন, ছনহরা, ধলঘাট, হাবিলাসদ্বীপ, জিরি, কুসুমপুরা, আশিয়া, কোলাগাঁও ছাড়াও পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড। শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধের ভাটিখাইন, ছনহরা ও কচুয়াইসহ বেশ কয়েকটি স্পটে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করে তলিয়ে গেছে আউশের বীজতলা।
Advertisement
কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম ইনজামুল হক জসিম জানান, শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে এখন কচুয়াইয়ের পুরো এলাকা তলিয়ে গেছে। এভাবে পানি জমে থাকলে বড় ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুল হাসান বলেন, টানা বর্ষণে পটিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যেসব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শনসহ ক্ষতিগ্রস্তদের নামের তালিকা সংগ্রহ করার কাজ চলছে।
পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের পটিয়া ও সীতাকুন্ড উপজেলা
এদিকে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার জানান, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে শঙ্খ নদীতে পানির উচ্চতা বেড়েছে। যে কারণে বাঁশখালীর পুুকুরিয়া ইউনিয়নের তেচ্ছিপাড়া এলাকায় গত দুইদিনে আটটি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শঙ্কার মুখে রয়েছে আরও ৩০টি বাড়ি। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সাধনপুর ও বৈলছড়ির পাহাড় থেকে ৬০টি পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন।
রাউজানে ভারী বর্ষণে ডাবুয়া ও সর্তা খাল দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে ফসলি জমি ও সড়ক। পানিতে তলিয়ে গেছে আমন ধানের বিস্তির্ণ বীজতলা। পানিতে ডুবে আছে হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্তা, হলদিয়া, গর্জনিয়া, এয়াসিন নগর , জনিপাথর, বৃকবানপুর, ডাবুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ডাবুয়া, লাঠিছড়ি, কেউকদাইর, রামনাথপাড়া, পূর্ব ডাবুয়া, হাসান খীল ও দক্ষিণ হিংগলা, চিকদাইর ইউনিয়নের পাঠানপাড়া, দক্ষিণ সর্তা ও চিকদাইর, গহিরা ইউনিয়নের দলইনগর ও কোতোয়ালিঘোনা, নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের সড়ক ও জমি। হালদা নদী ও তেলপারই খাল দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে নদীমপুর ও পশ্চিম নদীমপুর এলাকার ফসলি জমি।
পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের পটিয়া ও সীতাকুন্ড উপজেলা
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিয়াজ মোরশেদ বলেন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে রাউজানে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে সবচেয়ে বেশি ২৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে জেলার সীতাকুণ্ডে।
পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের পটিয়া ও সীতাকুন্ড উপজেলা
স্থানীয় সূত্র জানায়, রেকর্ড বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে সীতাকুণ্ডের নিম্নাঞ্চল। উপজেলার সীতাকুণ্ড পৌরসভা, বাঁশবাড়ীয়া, বাড়বকুণ্ড, মুরাদপুর, সৈয়দপুর ও বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের কিছু কিছু গ্রামসহ উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সীতাকুণ্ড উপজেলার রাস্তাঘাট। এতে করে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় অনেকে ভোগান্তিতে পড়েছে। এলাকায় অনেক বসতঘরে পানি ঢুকে চরম কষ্টে জীপনযাপন করছে মানুষ।
বৈরী আবহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ রুটে চারদিন ধরে নৌ-চলাচল বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এ রুটে যাতায়াত করা হাজারো মানুষ।
পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের পটিয়া ও সীতাকুন্ড উপজেলা
টানা বর্ষণে হালদা নদীর ফটিকছড়ি পয়েন্ট ও ধুরুংসহ বিভিন্ন খালের পানি বৃষ্টি পেয়ে উপজেলার দাঁতমারা, নারায়নহাট, ভুজপুর, সুয়াবিল, লেলাং, রোসাংগিরী, সমিতিরহাট ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে রয়েছে অর্ধশত গ্রামের বাসিন্দা। দাঁতমারা ইউনিয়নের হেয়াকো ফটিকছড়ি সড়কে বটতল এলাকায় একটি ব্রিজ ভেঙ্গে সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সমিতিরহাট ইউনিয়নে হালদায় বিলীন হয়েছে সাত বসতঘর। খিরামের পাহাড়ি এলাকা থেকে ২০ পরিবারকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে।
ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার লিটন দেব নাথ বলেন, অব্যাহত বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আউশ ধান ৫০ হেক্টর ও ৪০ হেক্টর বীজতলা পানির নিচে ডুবে রয়েছে।
আবু আজাদ/জেডএ/জেআইএম