অবশেষে ঘোষণা দিয়েই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে দিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম। এর আগে আন্দালিব রহমান পার্থ’র বিজেপিও ঐক্যফ্রন্ট ছেড়েছে। সেটি ছিল অনেকটাই হুট করেই। কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। তিনি বারবার ঐক্যফ্রন্টকে সতর্ক করেছেন। ছেড়ে যাওয়ার আগে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছেন এবং এরপরও যখন মনেরমতো কিছু হলো না তখন ঘোষণা দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট ছেড়েছেন।
Advertisement
ছেড়ে যাওয়ার সময় তার বক্তব্য ছিল অনেকটাই স্পষ্ট। অবশ্য বরাবরের মতোই তিনি স্পষ্ট কথা বলেন, সাহসী উচ্চারণ করেন। তাই নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হওয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে তার সেই সাহসিকতার পরিচয়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, নির্বাচনের পর এই সাত মাসে ঐক্যফ্রন্টের অস্তিত্ব খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। গেলো ৯মে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। কিন্তু এই দু’মাসে বস্তুত আলোচনা বা ঐক্যফ্রন্টকে বেগবান করার বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। যা হয়েছে তা মূলত লোক দেখানো বলে মনে করেন কাদের সিদ্দিকী।
একইসঙ্গে তিনি এও মনে করেন, নির্বাচনের পর ড. কামাল হোসেনের বাসায় যেসব বৈঠক হয়েছে তার বেশিরভাগই নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুহীন ও অসমাপ্ত আলোচনা। কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যকে সত্য ধরে নিয়ে যদি আলোচনা করি তবে একথা বলা বোধহয় ভুল হবে না যে, ‘ঐক্যফ্রন্ট’ কে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা নিয়ে তার বক্তব্য সঠিক। এবং একইসঙ্গে আরো একটি আলোচনা এসে যায়, তাহলে কি সত্যি যে, জোটের প্রতিটি দলের নেতারা তাদের মনোবল হারিয়েছেন। যদি হারিয়েই থাকে সেটি চাঙ্গা করার কোনো দায়িত্ব কেনো নিচ্ছে না শীর্ষ নেতৃত্ব। তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সরকার বিরোধী বেশিরভাগ সিদ্ধান্তে ঐক্যফ্রন্ট যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি সেই দায় অবশ্যই শীর্ষ নেতৃত্বের।
একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যার ভয়ে কাঁপতো পাক হানাদার বাহিনী সেই ‘বাঘা সিদ্দিকী’ একসময় যে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ট ছিলেন একথা সবাই জানেন। এখনো তিনি ‘মুজিব কোট’ গায়ে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ান, নিজেকে বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সন্তান বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের বড় বোনের মতোই দেখেন এবং বলে থাকেন আমৃত্যু তিনি এই শ্রদ্ধা অটুট রাখবেন। সে কারণে আগেই ধারণা করা হয়েছে নির্বাচনকে ঘিরে যে ঐক্যফ্রন্ট গড়া হয়েছে সেটির মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রচ্ছন্ন ছায়া রয়েছে এবং এটি বেশিদিন টেকসই হবে না।
Advertisement
টেকসই হতো যদি ঐক্যফ্রন্ট সরকার গঠন করতে পারতো। আবার আরেক পক্ষের ধারণা এতেও টেকসই হতো কি না সন্দেহ রয়েছে। কারণ সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী বা বিপরীত মেরুতে থাকা দুটি আদর্শ কোনো মতেই এক হতে পারে না। জামায়াতের সাথে জোট করে বা ধীরে ধীরে জামায়াতের আসক্তি বিএনপিরকে এখন অনেকটাই তার আদর্শিক জায়গা থেকে সরিয়ে এনেছে।
আবার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি গাঁটছড়া বেঁধে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন মানুষ দেখে থাকে সেটি থেকে দূরে সরে আছে। সে কারণে ড. কামাল বা কাদের সিদ্দিকীর মতো মানুষদের সঙ্গে যতোই জোট হোক না কেনো প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব কখনোই মেটা সম্ভব নয়। আবার একথা ঠিক যে, নির্বাচনের পরে এতো এতো ইস্যু সৃষ্টি হলো কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট জনগণের মনে আন্দোলন বা প্রতিবাদের আগুন জ্বালানোর মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। সে তুলনায় ছোট ছোট বাম দলগুলো তাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এতে আপাতদৃষ্টিতে কাজের কাজ কিছু না হলেও প্রতিবাদতো হলো।
তবে একথা ঠিক যে, আদর্শগত যতোই অমিল থাকুক না কেনো কাদের সিদ্দিকী তার বাক্যবাণে অনেকবার চেষ্টা করেছেন ঐক্যফ্রন্টকে রাস্তায় নামাতে কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি বৃথা বাক্য ব্যয় না করে নিজেওতো রাস্তায় নামতে পারতেন জনবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ জানিয়ে। বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সেই সামর্থ্য নেই। অথবা বলা যেতে পারে, অতীত অভিজ্ঞতায় তিনি মনোবল হারিয়েছেন। তাই তার গোস্বা হওয়াই স্বাভাবিক। তার সেই অভিমান, রাগ বা গোস্বাকে আরো উস্কে দিয়েছে সম্ভবত তাকে ঘিরে ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি নেতাদের এক ধরনের নির্লিপ্ততা।
সরকার বিরোধী তার এতো উস্কানিমূলক বক্তব্য বা নিজের ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে যাওয়ার পর এই কয়দিনেও কেউ তেমন একটা গা করেনি। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বরং দায়সারা উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘তিনি নিজের ইচ্ছেয় এসেছেন, নিজের ইচ্ছেয় চলে গেছেন’। তার মানেটা দাঁড়ায় এই, তাকে আমরা ডাকিনি। তিনি এলেন বলে থাকতে দিলাম। এখন চলে গেলেন তাতেই বা কী আসে যায়! অথচ এই কাদের সিদ্দিকী গেলো ৭ এপ্রিল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির উদ্যোগে ‘গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে’ আয়োজিত গণঅনশনে বলেছিলেন, ‘এ গণঅনশনে কিছু হবে না। যদি পারেন এক হয়ে রাস্তায় নামেন। যদি রাস্তায় নামতে পারেন তাহলে শেখ হাসিনা এক সময় বলবে ছেড়ে দে মা, আমি গেলাম, আমাকে মাফ করো।’
Advertisement
সেই অনুষ্ঠানে তাকে বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বর্তমানে দেশের যে অবস্থা এরকম অবস্থা হবে জানলে কাদের সিদ্দিকী-রব আপনারা কি মুক্তিযুদ্ধ করতেন?’ জবাবে বঙ্গবীর বলেছিলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি এর ১০০ ভাগের এক ভাগ হবে- এটা জানলেও আমি মুক্তিযুদ্ধ করতাম না।’ ‘আজ গণতন্ত্র আর খালেদা জিয়া এক কথা-এমন মন্তব্য করে কাদের সিদ্দিকী সেখানে বলেছিলেন, ‘যে আদালতে যে বিচারক বেগম খালেদা জিয়ার শাস্তি দিয়েছেন সেই বিচারকের জনগণের আদালতে শাস্তি হবে।’
তাহলে কি এটাই প্রমাণ হয়, কাদের সিদ্দিকী আসলে জনগণের চেয়ে নিজেরটাই ভালো বুঝেন। তিনি এখন ঐক্যফ্রন্টে সম্মান পাচ্ছেন না বলেই নিজেকে সরিয়ে এনেছেন। হয়তো ঋণখেলাপিসহ নানা কারণে সরকারের তিনি ঘনিষ্টজন হতে চাচ্ছেন। অথবা আগের ঘনিষ্ট সম্পর্ককে ঝালাই করতে যাচ্ছেন। বা আগামীতে নিজের সামর্থ্য নিয়ে সরকারের জনবিরোধী ইস্যুতে ভূমিকা রাখবেন। সেটা সময় বলে দেবে।
তবে জামায়াতের পত্রিকাতে লিখে বা তাদের চ্যানেলে টকশো করে মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী কিছুটা সম্মানতো খুঁইয়েছেন আগেই। সে কারণে তার মুখে এখন মুক্তিযুদ্ধ না করার কথাটাও বেশ মানিয়ে যায়!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ।
এইচআর/জেআইএম