দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলা মাহফুজা ও স্বর্ণালীদের স্বপ্নের পথচলা শুরু হলো। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া মাহফুজা-স্বর্ণালীদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
Advertisement
ফরিদপুর জেলায় পুলিশ কনস্টেবল পদে সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন তারা। বিনা টাকায় চাকরি পেয়ে হতদরিদ্র পরিবার দুটি খুশিতে আত্মহারা। শুধুমাত্র মাহফুজা-স্বর্ণালীই নয় বিনা টাকায় চাকরি পেয়েছেন জেলার আরও অনেকেই।
বুধবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের হলরুমে এক প্রেস বিফ্রিংয়ের আয়োজন করা হয়। প্রেস বিফ্রিংয়ে পুলিশ সুপার মো. জাকির হোসেন খান বলেন, কনস্টেবল হিসেবে ২৯ জন ছেলে ও ২৬ জন মেয়ে নিয়োগ পেয়েছেন।
তিনি বলেন, আইজিপি স্যারের নির্দেশনা ছিল পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগে কারও তদবির না শুনতে, সঠিক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। যে কারণে সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্য দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। মাত্র ১০০ টাকায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি হয়েছে। ফরমের জন্য তিন টাকা নেয়ার কথা থাকলেও ওই টাকা আমরা নিইনি।
Advertisement
প্রেস বিফ্রিং শেষে পুলিশ সুপার জাকির হোসেন খানসহ জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। এ সময় নিয়োগপ্রাপ্তদের মুখে মিষ্টি তুলে দেন পুলিশ সুপার।
তখন কথা হয় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত দিনমজুরের মেয়ে মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে। মাহফুজা আক্তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।
তিনি বলেন, ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার বাউতিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর হোসাইন মাতব্বরের মেয়ে আমি। ছয় বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। বড় বোন প্রতিবন্ধী। মেজো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোনেরা দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। বাবা হোসাইন মাতব্বরের নিজের বাড়ির জমিটুকু ছাড়া কিছুই নেই। অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেক কষ্ট করে, টিউশনি করিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে এসেছি। ২০১৮ সালে নগরকান্দা এমএন একাডেমি থেকে এসএসসি পাস করেছি আমি। বাবার একার উপার্জনে সংসার চলতো না, তাই টিউশনি করে নিজের পড়ালেখা চালিয়েছি এবং সংসারের বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্য করেছি। অনেক কষ্ট করেছি আমি।
মাহফুজা বলেন, একদিন পাশের বাড়ির এক ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম পুলিশে লোক নেবে। ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে ১০০ টাকা জমা দিয়ে আবেদন করি। আবেদন ফরম নিতে তিন টাকা নেয়ার কথা থাকলেও নেননি পুলিশ সুপার। মাত্র ১০০ টাকায় আমার পুলিশে চাকরি হয়ে গেলো। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। কোনোদিন ভাবিনি মাত্র ১০০ টাকায় পুলিশে চাকরি হবে। দিনমজুরের মেয়ে বলে মুখ তুলে তাকালেন আল্লাহ।
Advertisement
মাহফুজা আরও বলেন, বিনা ঘুষে পুলিশে চাকরি পাওয়ায় আমি মানুষের সেবা করব। মানুষের পাশে দাঁড়াব। দরিদ্র হওয়ায় সমাজে চলতে গিয়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সে কারণে দরিদ্র মানুষের পাশে আজীবন থাকব আমি। চাকরিকালীন কোনোদিন অনৈতিক কাজ বা অনৈতিক লেনদেন কিংবা ঘুষ নেব না, প্রতিজ্ঞা করলাম।
এরার কথা হয় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত আরেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান স্বর্ণালী আক্তারের সঙ্গে। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বর্ণালী।
তিনি বলেন, জেলার বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের আখালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব শেখের মেয়ে আমি। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়। বাবা আইয়ুব শেখের কয়েক শতাংশ জমির ওপর একটি ছোট্ট ঘরে আমাদের বসবাস। বাবা অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন, আবার কোনো সময় রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ওখান থেকে যা রোজগার হয় তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলে আমাদের।
স্বর্ণালীর ভাষ্য, ২০১৭ সালে নদের চাঁদ পিসি দাস একাডেমি থেকে এসএসসি পাস করি। ছোটবেলা থেকে টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়ে আসছি। অভাবের সংসারে পড়ালেখা চালিয়ে আসা আমার জন্য অনেক কষ্টের। তবুও পড়ালেখা চালিয়ে আসছি। জীবনে ভাবতে পারিনি এভাবে পুলিশে চাকরি হয়ে যাবে।
স্বর্ণালী বলেন, কিছুদিন আগে আমি যে বাড়িতে টিউশনি করতাম সেই বাড়ির এক ভাই বলল পুলিশে লোক নেবে। তুমি আবেদন করো। তার কথাতেই ১০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফট করে আবেদন জমা দেই। ফরমের জন্য তিন টাকা দেয়ার কথা থাকলেও ওই টাকা আমার কাছ থেকে নেয়া হয়নি। এরপর মাঠে আসলাম, শারীরিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর মেডিকেল সম্পন্ন করলাম। পুলিশে চাকরি পেয়ে গেলাম। আমার এখনো ভাবতে অবাক লাগে। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আমি বা আমার পরিবার কখনো ভাবিনি আমার পুলিশে চাকরি হবে। চাকরি পেয়েছি, আমার বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলো এখন পূরণ করব। পরিবারের পাশাপাশি সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়াব।
জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৩ জুলাই থেকে ফরিদপুর পুলিশ লাইন মাঠে কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৪ জুলাই লিখিত পরীক্ষা, ৮ জুলাই মৌখিক পরীক্ষা শেষে ৯ জুলাই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ১০ জুলাই নিয়োগপ্রাপ্তদের মেডিকেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
বি কে সিকদার সজল/এএম/জেআইএম