বিশেষ প্রতিবেদন

তাকে যেন আর খোঁজা না হয় : মাকে বলেছিল তানজি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহার করে ইরাকে কথিত ধর্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া জঙ্গি সংগঠন আইএসএ যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার তরুণী। তাদের সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময়ও লাগেনি। কিন্তু সেই একই কায়দায় দেশের ধর্মভিরু তরুণীদের দলে ভেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলাম। 

Advertisement

তেমনই এক তরুণী চট্টগ্রামের সাফিয়া আক্তার তানজি। যাকে গত সোমবার (৮ জুলাই) মধ্যরাতে বরিশালের একটি মাদরাসা থেকে উদ্ধার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)

আরও পড়ুন >> জঙ্গি বানাতে প্রেমের ফাঁদ!

গতকাল মঙ্গলবার (৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লে. কর্নেল এমরানুল হাসান গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।

Advertisement

যেভাবে জঙ্গি দলে চট্টগ্রামের মেয়ে তানজি 

র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া সাফিয়া আক্তার ওরফে তানজি চট্টগ্রাম মহানগরের বন্দর থানার সল্টগোলা ক্রসিং এলাকার বাসিন্দা হাফেজ আবদুস সালামের মেয়ে। গত ২৬ জুন কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন তানজি। এ ঘটনায় তার বাবা হাফেজ আবদুস সালাম বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (জিডি নম্বর- ৩৯৬)। 

র‌্যাব-৭ সূত্রে জানা যায়, মেয়ের সন্ধান চেয়ে বাবা আবদুস সালামের করা জিডি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় র‌্যাব। অনুসন্ধানের শুরুতেই জানা যায়, সাইফা আক্তার তানজি গ্রামের (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) কলেজে লেখাপড়ার সময় ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। দুই বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে থাকলেও তার সে আসক্তি কমেনি। তানজির সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম দলে টানে তাদের আরেক নারী সদস্যকে ব্যবহার করে। 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত থেকে তানজি আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেই গ্রুপের আরেক সদস্য নাইমার সহায়তায় আইএস স্টাইলে তানজিকে নিজেদের দলে ভেড়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলাম। তাদের টার্গেট হিসেবে তানজি ছিল ধর্মভীরু, সহজ-সরল ও শান্তিপ্রিয় মেয়ে। যাকে সহজে নাশকতা সৃষ্টি ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে দলে ধরে রাখতে আইএসের আরেক কৌশল অনুসারে তানজিকে আনসার আল ইসলামের অপর সদস্য সাইফের সঙ্গে বিয়ের প্রলোভনও দেখানো হয়।

Advertisement

মাকে তানজি বলে যায়, তাকে যেন খোঁজা না হয়

বন্দর থানায় দায়ের সাধারণ ডায়েরিতে তানজির বাবা হাফেজ আবদুস সালাম উল্লেখ করেন, গত ২৬ জুন সকাল ১০টায় কোনো এক অজানা কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয় তানজি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলে যায়, ‘তাকে যেন খোঁজা না হয়। সে যেখানে যাচ্ছে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।’ 

আরও পড়ুন >> বেঁচে নেই সিলেটের একই পরিবারের সেই ১২ জন

অনুসন্ধানে নেমে র‌্যাব পরিবারের সঙ্গে তানজির ম্যাসেজ আদান-প্রদান ও ফোন কলের সূত্র ধরে জানতে পারে, বাসা থেকে বেরিয়ে তানজি আনসার আল ইসলামের নারী সদস্য নাঈমার সঙ্গে দেখা করে। সেখান থেকে নাঈমা তার সংগঠনের নির্দেশে তানজিকে নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তানজি ও নাঈমা গত ২৬ জুন রাত ৯টায় বরিশাল শহরের একটা বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামেন।

সূত্র জানায়, বরিশালের সাইফের আশ্রয়-প্রশ্রয় রাখার প্রলোভন এবং বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তানজিকে ঘর থেকে বের করা হয়। বরিশাল শহরের একটি হাই স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করা সাইফ আনসার আল ইসলামের নেতৃস্থানীয় সদস্য। গত ২৬ জুন রাতে পূর্ব থেকে অপেক্ষমাণ আনসার আল ইসলামের স্থানীয় সংগঠক সাইফ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের একটি মাদরাসায় তানজিকে ভর্তি করান। তানজিকে জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে নাঈমা নিজেও ছাত্রী হিসেবে স্থানীয় আরেকটি মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে ভর্তি ফিসহ মাদরাসায় থাকা-খাওয়ার টাকা আনসার আল ইসলামের স্থানীয় সংগঠক সাইফ নিজেই পরিশোধ করেন। 

যেভাবে উদ্ধার হলেন সাফিয়া আক্তার তানজি 

তানজির বাবার জিডির সূত্র ধরে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সদর দফতর তার বিভিন্ন ইউনিটকে কাজে লাগায়। পরে প্রযুক্তির সাহায্যে তানজির অবস্থান শনাক্ত হলে বিশেষ অভিযানে নামে র‌্যাব-২ এর একটি আভিযানিক দল। যার নেতৃত্ব দেন ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-৩ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ফারুকী। 

আরও পড়ুন >> আটজনের কাছে বিক্রি, ধর্ষণ করতো তিনজন

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা সাইফা আক্তার তানজিকে তাদেরই আরেক নারী সদস্যের সহযোগিতায় জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য বের করে নিয়ে গেছে। সেখানেই তানজিকে সাইফের সঙ্গে বিবাহ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। এরই মাঝে গত সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে র‌্যাব- ২ এর আভিযানিক দল বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ওই আবাসিক মহিলা মাদরাসা থেকে তানজিকে উদ্ধার করে। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী আনসার আল ইসলামের নারী সদস্য নাঈমাকে বরিশাল শহরের রূপাতলী মাদরাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। নাঈমার দেয়া তথ্যে গতকাল মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সকালে রাজধানীর ডেমরা থেকে গ্রেফতার করা হয় আনসার আল ইসলামের পুরুষ সদস্য আফজালকে। 

বিয়ে করে জিহাদের জন্য প্রস্তুত হবে তানজি

অনলাইনে চটকদার সব কৌশল ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আইএস পশ্চিমা তরুণীদের আকৃষ্ট করেছিল। টুইটার, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের টার্গেট করা নারীদের দলে ভেড়াত। পরে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো বিয়ের কৌশল। সেই একই কৌশল ব্যবহার করে তানজিকেও আনসার আল ইসলাম তাদের ফাঁদে আটকাতে চেয়েছিল।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তানজি র‌্যাবকে জানায়, তার ফেসবুক বন্ধু নাঈমা ও অন্যান্য সাথীদের প্ররোচনায় সে আনসার আল ইসলামের নেতৃস্থানীয় সদস্য সাইফকে বিবাহ করে স্বামীর চাহিদা অনুযায়ী জিহাদে শামিল হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তানজি আরও জানায়, সাইফ জিহাদি মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি। ফেসবুকে বা ফোনে যখনই তার সাথে কথা হতো, সাইফ প্রকারান্তরে তানজিকে জিহাদে শামিল হওয়া, একই সাথে শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করা, শহীদের রাস্তায় মৃত্যু কামনা করাসহ সর্বাবস্থায় তাকে জিহাদে শামিল বা কালো পতাকার নিচে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাত। 

আরও পড়ুন >> ‘বাংলাদেশে ঢুকলেই শামীমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে’

তানজি আরও জানায়, মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সময় তানজি সাইফের কথা অনুযায়ী তানজি ও তার ‘সাথী বোন’ নাঈমা একই পিতার কন্যা পরিচয় দিয়ে মাদরাসায় ভর্তি হয়। 

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে শুদ্ধস্বর প্রকাশনার কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সে হামলায় অংশ নেয় আনসার আল ইসলামের সদস্য সুমন হোসেন পাটোয়ারী। সুমনের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও বড় হয়েছেন চট্টগ্রামের হালিশহরে। সেখানেই বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে থাকতেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু পাস করতে পারেননি। এ তরুণ চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় একটি মেডিকেল ইকুইপমেন্টের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করতেন। সে সময় সুমন আদালতকে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে জানান, সদস্য সংগ্রহে আল-কায়েদা বা আইএসের ম্যানুয়াল অনুসরণ করে আনসার আল ইসলাম।

আবু আজাদ/এমএআর/এমকেএইচ