এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ মঞ্চের দুই বীর আমাদের সাকিব-মুস্তাফিজ। এ দুজনকে নিয়ে আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে যে পারফরমেন্স করল, যে আশা আমাদের জাগ্রত করল; তা বহুদিন আমাদের জাতির মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিবে। সাকিব আগেই ছিল বিশ্ব র্যাংকিঙে সেরা অলরাউন্ডার। কিন্তু এবারে ব্যাট হাতে যে সাফল্য সে অর্জন করেছে, তা বিশ্বের যে কোনো সেরা ব্যাটসম্যানের জন্য ঈর্ষণীয়। ৬০৬ রান করে এই তরুণ এখন বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা রান সংগ্রাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
Advertisement
আর কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নিয়ে তারুণ্যের যে দ্যুতি ছড়িয়েছে, তা বিস্ময় জাগানিয়া। বিশেষভাবে বলতেই হয়, বিশ্বকাপের দুই নম্বর দল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩০০ রান করে কিংবা এক নম্বর দল ভারতকে পরাজয়ের চিন্তায় ফেলে দিয়ে আমাদের ক্রিকেট দল যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, তাতে মনে হয়েছিল আমরা বুঝি শেষ চার তো বটেই এমনকি ফাইনালেও খেলতে পারব। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেট জায়ান্টদের পরাজিত করে সেমিফাইনালে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, বিশ্বকাপে অন্তত সেমিফাইনাল খেলতে পারব বলে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার আশার পারদ যেভাবে সুউচ্চে উঠেছিল, তাতে সবাই তেমনভাবে পারফরমেন্স করতে না পারায় এই দুজনের প্রশংসার সঙ্গে অন্য খেলোয়াড়দের সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এটাই বাস্তব যে, ক্রিকেট সবসময়েই দলের খেলা, ব্যক্তি সেখানে দল থেকে অনুপ্রেরণা পায়, দলের হয়েই খেলে। অতীত ক্রিকেটারদের ধারাবাহিকতায় এই টিমই ওই দুই ক্রিকেটারকে গড়ে তুলেছে।
এই দলটির পারফরমেন্স ভবিষ্যতে বিশ্বকাপ জয়ের যে আশা জাগিয়েছে, তা বোধকরি বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থভাবেই টাইগারদের অযথা সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। জাতির প্রাণের কথার প্রতিধ্বনি করে তিনি সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘এতদূর যে যেতে পেরেছি, এটা অনেক বড় ব্যাপার।’ ক্রিকেটারদের ‘সাহসী মনোভাবের’ তিনি যারপরনাই প্রশংসা করেছেন। সাহসটাই আসলে বড়।
Advertisement
মঞ্চ কতটা বড় আর কতটা ছোট এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেও বলতেই হয় ক্রিকেট উন্মাদনার ডামাডোলের মধ্যে গানের জগতে আমাদের তরুণ সমাজের আরো একটি অর্জনের কথা। ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায় জি টিভির ‘সারেগামা’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ নিঃসন্দেহে সাড়া জাগানিয়া ও জনপ্রিয়। সেই মঞ্চে আমাদের নোবেল যেভাবে পারফরম করল তা বিস্ময়কর।
বিচারক-দর্শকসহ অনেককেই এই তরুণ চোখের জলে সিক্ত করেছে। কলকাতা থেকে একজন সুহৃদ টেলিফোনে বলল, ওর মুখে মা গানটি শুনলে কার চোখে না জল ঝরবে! এটা ঠিক যে প্রতিযোগিতায় নোবেল বাংলাদেশের মর্যাদাকে সুউচ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কলকাতার টিভি সিরিয়ালের অভিনয়েও আমাদের দেশের তরুণরা প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর রেখেছে। কলকাতায় গেলে তাদের নাম মানুষের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত কেবল ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক জগতে নয়, দেশ যে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠছে, তাও কিন্তু তরুণ সমাজেরই অবদান।
বলাই বাহুল্য, এই প্রজন্মের তরুণরা আমাদের গর্ব। তারুণ্যের প্রতীক, একান্ত ভরসাস্থল। এদের দিকে তাকালে স্থির বিশ্বাস জন্ম নেয়, ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ উঠে আসছে। প্রসঙ্গক্রমে অনৈতিক অনেক নেতিবাচক ঘটনাই আমাদের অহরহ পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণভাবে খারাপটাই মানুষকে নাড়া দেয় বেশি। আমাদের মানসিক গড়নটাও যেন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কেবল নেতিবাচক দিকটা দেখা।
এদিকে সাকিব-মুস্তাফিজসহ ক্রিকেট বীরদের কিংবা সংস্কৃতি জগতের নোবেলদের মুখটা যখন ভেসে ওঠে, তখন মনে পড়ে প্রাচীন পুঁথি কৃষ্ণলীলার একটি পদের লাইন: ‘তোমাকে বধিবে যে/গোকুলে বাড়িছে সে।’ অবতার ভগবান কৃষ্ণ দুর্বিনীত রাজা কংসকে বধের জন্য বেড়ে উঠেছে গোকুলে পালক মাতা যশোদার গৃহে। প্রকৃত বিচারেই আমাদের গোচরে-অগোচরে নতুন বাংলাদেশ গড়ার নায়করা জন্ম নিচ্ছে- যারা সমাজে বেড়ে ওঠা অসুরদের কেবল কথায় নয় কাজে পদানত-পরাভূত করবে। তারাই অসুর শক্তিকে বশে এনে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড় করাবে বাংলাদেশকে।
Advertisement
এসব কথা মনে হতেই নস্টালজিয়ায় ভেসে যাই। রাজনীতির অঙ্গনের মানুষ রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে সবকিছু ভাবে। আর রক্তস্রোতের ভেতর দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়া বাংলাদেশ তো শেষ বিচারে রাজনীতিরই ফসল। স্বাধীনতার জন্য এতটা আত্মত্যাগ কোন জাতি করেছে! এখনো মনে পড়ে ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে গেছি ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-কমনওয়েলথ দলের ক্রিকেট টেস্ট খেলা দেখতে। কোনো বাঙালি খেলোয়াড়ের একাদশে স্থান পাওয়া তখন কঠিন ব্যাপার।
বাঙালি সেন্টিমেন্টের মুখে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন লতিফ। গ্যালারি থেকে তাকে নামানোর স্লোগান উঠতে থাকল। এক সময় তাকে নামাতেই হলো। তখন সে কি উত্তেজনা! ওর সমর্থনে গ্যালারিতে হাততালি, চিৎকার, স্লোগান জমে উঠল। সেসব স্মৃতি স্মরণে এলে মনে হয়, বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণে ক্রিকেটেরও অবদান রয়েছে। আর সাংস্কৃতিক জগতের অবদান তো অবিস্মরণীয়। দমন-পীড়নের জন্য যখন রাজনৈতিক আন্দোলন অগ্রসর করা অসম্ভব হতো, তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলন পথ দেখাতো মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে।
তাই বলতেই হয়, অনেক সময়েই দেখা যায় কোনো কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী-মহল খেলাধুলা নিয়ে আলোচনায় রাজনীতির প্রসঙ্গ আনতে চান না। পৃথক করতে প্রয়াসী হন। প্রকৃত বিচারে বাংলাদেশ যদি হয়ে থাকত পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাঞ্জাবের উপনিবেশ, তবে নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে আসতে পারত না। গোলাম হয়ে পদানত থাকতে হতো। এমন এক দেশের অংশ ছিলাম, যেখানে মোনায়েম খান খয়েরখা বুদ্ধিজীবীদের বলেছিল, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না’।
আরো একটি বিষয় লক্ষ করার মতো। দেশের অতীত রাজনীতিতে সংস্কৃতি আমাদের জাতিকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনে হয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমরা আঁস্তাকুড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এই রাজনীতি হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যু, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক আইনের শাসনের ভেতর দিয়ে রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছে।
সমাজ ও রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে। এই বাস্তবতায় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম আমাদের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মতো অবস্থান নিয়ে যেতে পারে। কেননা সাকিব-মুশফিকুর-তামিমের রান আর সৌম্য-লিটনের রানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। যেমন ভেদাভেদ নেই নোবেলের গানের সঙ্গে ভারতীয়দের গান। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় তরুণরা যখন অবদান রাখে, তখন হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বিভেদ করা যায় না। সবই যোগ হয় দেশের পক্ষে।
সর্বোপরি একটা কথা মনে রাখতেই হবে যে, দেশের সমৃদ্ধি ও সুখ-শান্তির সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণ সমাজের উত্থান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটা অপরটার সম্পূরক। আর্থিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন মানসিক ক্ষেত্রের উন্নয়নের সঙ্গে সমানুপাতিক। তাই তরুণ সমাজের অর্জনগুলোকে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির সঙ্গে পৃথক করার কোনো অবকাশ নেই। সিঙ্গাপুরে এসে অখণ্ড অবসরের মধ্যে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইংল্যান্ডের রাস্তায় যখন সাকিবদের সম্মান ও মর্যাদা জাগানিয়া জনপ্রিয়তা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে নোবেলকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখি, তখন মনে জাগে সুখস্মৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব জার্মানির রাজধানী বার্লিনে যুব উৎসব। বড় এক প্রতিনিধিদলে কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে যাই সেখানে। তিন দেশের নাম তখন বার্লিনের পথে-ঘাটে-অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হচ্ছে, শেখ মুজিবের বাংলাদেশ, হো চি মিনের ভিয়েতনাম ও আলেন্দ্রের চিলি। সশস্ত্র বিপ্লবে বিজয়ী বাংলাদেশ রয়েছে সবার আগে। অনুষ্ঠানে ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কত যে নিমন্ত্রণ! প্রোগ্রাম মেলাতে কষ্ট হতো। ‘জয় জয় নবোজাত বাংলাদেশ/জয় জয় মুক্তিবাহিনী..’ গানটা বিদেশিরা যেখানে দেখা হতো সেখানেই ভাঙা বাংলায় গেয়ে অভ্যর্থনা জানাতো।
তৃণমূল পর্যায়ে বেড়ে যাচ্ছে ময়ূরপুচ্ছ পড়া ‘কাউওয়াদের’ উৎপাত। নিঃসন্দেহে নিচ থেকে ওপরে অতীতের মতোই চেইন গড়ে উঠছে। দেশের তরুণরা যখন দেশের মাথা উঁচু করছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশ যখন বিশ্বে উদাহরণ স্থানীয় হচ্ছে, তখনই সময় হচ্ছে কথিত ‘চোর-চোট্টা-বদমাইশদের’ বিরুদ্ধে নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুযায়ী ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কার্যকর করার।
রক্ত জল করে যারা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে, বিদেশে বসে কেন তাদের কাছে শুনতে হবে প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা ছাড়া পেল কীভাবে? কেন সব অনভিপ্রেত ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীকে আদেশ-নির্দেশ দিতে হবে? অন্য মন্ত্রীরা বা সংগঠন কী করে? যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের দলের সদস্যপদ দেয়া নিয়ে এমন বিভ্রান্তকর পরিস্থিতি হওয়াটা কি সঙ্গত? এসব প্রশ্ন থেকে যে প্রশ্নটি বেশি উত্থাপিত হয়, তা হলো- যুব সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ব পরিমণ্ডলে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তার সঙ্গে কি আমাদের ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মকাণ্ড সঙ্গতিপূর্ণ? ওইসব কর্মকাণ্ড কি যুব সমাজের প্রতিভা বিকাশের সহায়ক? ধারণা করি কেউ এই প্রশ্নে হ্যাঁ জবাব দিবে না।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের বলা হয়েছে যে, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনী অঙ্গীকার রূপকল্প-২০২১ আমরা নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে উৎসর্গ করেছিলাম। ২০১৪ সালের নির্বাচনী অঙ্গীকার রূপকল্প-২০৪১ আমরা প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আজ তরুণ যুবকরা আবারো মুক্তিযোদ্ধাদের মতো মাথা তুলে গর্বভরে দাঁড়িয়েছে।
এবারের নির্বাচনী অঙ্গীকার তাই নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার। একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামরত তরুণ-তরুণীরাই এই অঙ্গীকারকে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। এই কথাগুলো কতটা বাস্তবায়িত করতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ, তা দিয়েই বর্তমান পর্যায়ে নির্ভর করবে তরুণ প্রজন্ম বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
এইচআর/এমকেএইচ