কারও বাবা রিকশা চালক। কেউবা দিন মুজুর। কারও বাবা নেই। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। কেউবা গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসারের হাল ধরেছিলেন। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি কেউ কেউ সংসারের একমাত্র অবলম্বনও ছিলেন। কিন্তু মাত্র ১০৩ টাকায় চাকরি পেয়ে এখন অনেকেরই জীবনের গল্পটা পাল্টে যাচ্ছে। কুমিল্লায় জেলায় সদ্য নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কনস্টেবলদের মঙ্গলবার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। এ নিয়োগে চাকরি পেয়েছেন গার্মেন্টস কর্মী, দিনমজুর, সবজি বিক্রেতা, কৃষক, ভ্যান ও রিকশাচালকের সন্তানসহ ৩০৭ জন। বিনা টাকায় চাকরি পেয়ে হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোতে চলছে আনন্দের বন্যা। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
Advertisement
চোখে আনন্দ অশ্রু আর শত কষ্ট ছাপিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা চাকরি পাওয়ার বর্ণনা দেন। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার নিলখী নয়াহাটি গ্রামের কোহিনুর আক্তার। তিনি জানান, ২০১০ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন তার বাবা শহিদুল ইসলাম। চার ভাই, এক বোন ও মা নিয়ে তাদের অভাবের সংসার। টিউশনি করে যা পেতেন তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসারের হাল ধরেন কোহিনুর।
জেলার বুড়িচং উপজেলা সদরের সাবের আহম্মেদের মেয়ে কাজল রেখা সোমার গল্পটা ভিন্ন। হতদরিদ্র পরিবারে আট বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি পঞ্চম। পুলিশে কনস্টেবল পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা দিয়ে কুমিল্লা ইপিজেডের একটি গার্মেন্টসে কর্মস্থলে চলে যান তিনি। এইচএসসি উত্তীর্ণ সোমা কর্মস্থল থেকে ছুটি না পাওয়ায় লিখিত পরীক্ষার ফলাফলও জানতে পারেননি। মৌখিক পরীক্ষার দিন উপস্থিত না দেখে জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে এক কর্মকর্তা সোমাকে মোবাইল ফোনে জেলা পুলিশ লাইন্সে ডেকে নেন। এরপর মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আসেন মাকে নিয়ে। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তার মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সোমা গান গেয়ে শুনান।
নিয়োগপ্রাপ্ত কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের হারুন মিয়ার মেয়ে আছমা আক্তার জানান, কয়েক বছর আগে তার বাবা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে বাড়িতেই থাকেন। বাবা-মা ও ৬ বোনের সংসারে তার মায়ের ১৮০ টাকা দৈনিক মজুরি পরিবারটির ভরণপোষণের একমাত্র অবলম্বন। তিনি বলেন, ১০৩ টাকায় চাকরি পাবো তা জীবনেও কল্পনা করিনি।
Advertisement
সম্পত্তি বলতে বসতবাড়ির একটি ছাপড়া ঘর রয়েছে জেলার বুড়িচং উপজেলার জগতপুর গ্রামের আইরিন সুলতানার। তিনি জানান, তার বাবা হাবিবুর রহমান দিনমুজুর। আর্থিক কারণে আইরিন এসএসসির পর আর লেখাপড়ায় এগুতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে তাকে চাকরি নিতে হয় স্থানীয় একটি স্পিনিং মিলে। এতো সহজেই বিনা টাকায় চাকরি মিলবে তা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
জন্মের এক বছর পরই বাবা হারান চাকরি পাওয়া বুড়িচং উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামের সাবরিনা আক্তার। তিনি বলেন, বাবা আবুল কালামের মৃত্যুর পর আমার মা আমাকে নিয়ে মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে মামার অনুগ্রহে লেখাপড়া শুরু করি। এ বছর কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। পুলিশে চাকরি পেতে ৮/১০ লাখ টাকা দরকার এমনই ধারণা আগে থাকলেও পুলিশ সুপারের ১০৩ টাকায় চাকরি পাওয়ার ঘোষণা দেখে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।
দেবিদ্বার উপজেলার মোহনপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক ওমর ফারুকের মেয়ে কামরুন নাহার বলেন, চার ভাই-বোনের সংসারে অভাবের কারণে আমার লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হলেও কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে যাই। এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশে নিয়োগের জন্য এসে এভাবেই সফল হবো তা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।
জেলার বরুড়া উপজেলার ঝিকুটিয়া গ্রামের মোকশত আলীর মেয়ে তাছপিয়া জাহান প্রিয়াংকা জানান, তার বাবা অনেক আগে মারা গেছেন। তার মা ক্যানসারের রোগী, তাকে নিয়মিত কেমোথেরাপি দিতে হয়। ৫ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে প্রিয়াংকার এ চাকরি তার জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো।
Advertisement
একই উপজেলার দাদীসার গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বাবা জসিম উদ্দিনের মৃত্যুর পর ৩ বোন ও ১ ভাই নিয়ে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পেতেন তাই দিয়েই আমাদের কোনো রকম সংসার চলতো। গ্রামে টিউশনি করে নিজের ও ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ চালাতাম। এভাবেই বিনা টাকায় হাতে চাকরি পাব তা চিন্তা করিনি কখনো।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া নগরীর কাপ্তান বাজার এলাকার লুৎফুর হোসাইন বলেন, বিনা টাকায় চাকরি হয়? এটা কোনো মানুষই বিশ্বাস করবে না, তাও আবার পুলিশের চাকরি। কখনো এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, বিনা টাকায় আমার চাকরি হবে।
তিনি জানান, ১২ বছর আগে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর তাদের ৭ বোন ও ৫ ভাইয়ের লেখাপড়াসহ সকল খরচ বহন করতে গিয়ে তার মাকে হিমশিম খেতে হয়। টানাপোড়েনের এই পরিবারে তার বাবার সনদে চাকরি পেয়ে তিনি খুশি।
মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার নবীয়াবাদ গ্রামের রবিউল আউয়াল জানান, ছয় বছর আগে তার বাবা মারা গেছেন। অভাবের সংসার। তার ধারণা ছিল, গরিবের সন্তান, টাকা দিতে পারবে না তাই চাকরিও হবে না। বিনা টাকায় চাকরি হবে, কখনো কল্পনাতেও ছিল না। তবে এমন ধারণা বদলে গেছে কুমিল্লার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামের উদারতায়। এখন বাংলাদেশ পুলিশের একজন সৎ ও সাহসী পুলিশ সদস্য হওয়ার শপথ নিয়েছেন।
শুধু কোহিনুর, রবিউল, সাবরিনা কিংবা কাজল রেখা নন, জেলা পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ৩০৭ জনের মধ্যে অনেকের রয়েছে এমন আরও ব্যতিক্রমী গল্প।
মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের শহীদ আরআই এবিএম আবদুল হালিম মিলনায়তনে জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। ওই অনুষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তদের বাবা-মা, পরিবারের সদস্য এবং নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছাড়াও জেলা পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও নগরীর বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১ জুলাই থেকে কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স মাঠে কনস্টেবল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। চূড়ান্ত নিয়োগে ছেলেদের ১৭৩ জনের মধ্যে সাধারণ কোটায় ১১৫ জন, এতিম কোটা ২, আনসার ৩, পোষ্য ৭ ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৪৬ জন এবং মেয়েদের ১৩৪ জনের মধ্যে সাধারণ ১২৯, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩ জন, পোষ্য ও এতিম কোটায় ১ জন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। এ নিয়োগে চাকরি পেয়েছেন গার্মেন্টসকর্মী, দিনমজুর, সবজি বিক্রেতা, কৃষক, ভ্যান ও রিকশাচালকের সন্তানসহ ৩০৭ জন।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং আইজিপি স্যারের নির্দেশনা ছিল পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগে কারো তদবির না শুনতে, সঠিক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। যে কারণে সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্য দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এর আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের পর থেকে প্রতারক ও দালাল চক্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য জেলাব্যাপী মসজিদ ও হাটবাজারে লিফলেট বিতরণসহ মাইকিং ও নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখন থেকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। এই নিয়োগ তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কামাল উদ্দিন/আরএআর/এমএস