আইন-আদালত

কিছু ওসি-ডিসি নিজেদের জমিদার মনে করেন

মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।

Advertisement

জামিন আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মঙ্গলবার তা খারিজ করে দেন।

আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. আহসান উল্লাহ ও সালমা সুলতানা। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এবং তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী মো. আব্বাস উদ্দিন। এ সময় জামিন শুনানিতে আদালত বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে যে অবান্তর প্রশ্ন করেছিলেন তা বলার মতো বিষয় নয়। তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখলে সে মারা যেত না। কিন্তু তা না করে ভিডিও করে মজা নিয়েছেন। তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। অভিযোগ নেয়ার পর তিনি যদি প্রটেকশন দিতেন তাহলে এ ঘটনা নাও ঘটতে পারত।

হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘কিছু কিছু ওসি ও ডিসি রয়েছেন যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। মনে হয় তারাই অল ইন অল।’

Advertisement

শুনানির শুরুতে আইনজীবী মো. আহসান উল্লাহ আদালতে বলেন, বাদী অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে ফেসবুকে লাইভ দেন। যেহেতু অধ্যক্ষ কক্ষে নিয়ে ওই ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন এবং ওসি নিয়ম বহির্ভূতভাবে নুসরাতের ভিডিও করেন এবং সময় টিভির বরাত দিয়ে (ভাইরাল হওয়া ভিডিওর কনভারসেশন) করা হয়েছিল। পরে শিক্ষার্থীরা মুখোশ পরে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয় এবং কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে হত্যা করে। তদন্তে সেসব তথ্যসহ তিনটি বিষয় উঠে এসেছে।

ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আরও বলেন, তিনি (ওসি মোয়াজ্জেম) ভিডিও করলেও তা তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেননি। সজল নামে এক সাংবাদিক ওই ভিডিও ছড়িয়েছেন। তখন আদালত বলেন, সাংবাদিকরা বিষয়টি আগে জানলে নুসরাতের এমন মৃত্যু নাও হতে পারত।

আইনজীবী বলেন, সাংবাদিকরা এখন তেলাপিয়া মাছের মতো। অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা করলে হয়তো প্রশ্ন করা হতো, কত টাকা নিয়ে অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন? কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে ধারায় তার (ওসি) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেটা তার অপরাধ। তিনি মানহানি করেছেন। তবে, এ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় কারও মানহানি ঘটলে সেই অপরাধে সাজা হবে তিন বছর বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আছে, কেউ যদি ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল ডিভাইসে প্রকাশ করে তার উপরোক্ত সাজা হবে। ওসি শত্রুতাবশত এটা (ভিডিও) করেননি।

Advertisement

ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাস্তা দিয়ে আসার সময় দেখেছি, গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, সেটা নাশকতা। আর কুরআনের আয়াত নিয়ে কটূক্তি করায় ব্লগার রাজিবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটা সাম্প্রদায়িকতা।

এ সময় আদালত বলেন, আপনি যে এতক্ষণ এসব গাইলেন, কোনো কাজে আসবে না। আপনি এসব পড়ে সময় নষ্ট করছেন। জামিনের মূল গ্রাউন্ডে কথা বলুন। জামিন চাইছেন গ্রাইন্ড কী?

আইনজীবী বলেন, সেই অপরাধে সাজার মাত্রা কম, অপরাধটি জামিনযোগ্য এবং তিনি অসুস্থ, তার চিকিৎসা দরকার। এ কারণে জামিন আবেদন করেছি। এছাড়া তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, তার পেনশনের বিষয় আছে। জামিন দিলে তো তিনি পালিয়ে যাবেন না।

আদালত বলেন, তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগটি গুরুতর, অপরাধের সাজা কম বা বেশি তা বড় কথা নয়।

ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, তিনি বয়স্ক। কানে সমস্যা, কম শোনেন। আদালত তখন প্রশ্ন তোলেন, বয়স কত। আইনজীবী বলেন, ৫০ বছর। এ সময় আদালতে উপস্থিত সকলে হেসে ওঠেন। হাইকোর্ট এ সময় বলেন, তিনি কানে কম শুনলে ওসির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কেমনে থাকেন? এরপর মোয়াজ্জেমের আইনজীবী মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্তব্য করলে আদালত বলেন, সাংবাদিকরা যদি শুরু থেকেই এ ঘটনার পেছনে লেগে থাকত, তাহলে এ ঘটনা (নুসরাতের মৃত্যু) ঘটত না। সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। ব্যারিস্টার সুমনও সমাজের দর্পণ। তখন মেয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, সরকারি চাকরি যারা করেন তারাই জানেন তাদের কী কষ্ট!

প্রসঙ্গত, গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় আলিম পরীক্ষাকেন্দ্রে গেলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়।

মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতহানির মামলা তুলে না নেয়ায় তাকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে- যা মৃত্যুশয্যায় নুসরাত বলে যান।

এর আগে নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তার মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় ডেকে নিয়ে নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। পরে সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েও দেন তিনি।

ওই ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ১৫ এপ্রিল ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ ও মামলার নথি পর্যালোচনা করে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জগলুল হোসেন ২৭ মে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ২০ দিনের মাথায় গত ১৬ জুন মোয়াজ্জেম হোসেনকে হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ।

গত ১৭ জুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় গ্রেফতার ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

গত ৩০ জুন ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবী। ১ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আবেদনটি উপস্থাপনের পর এ বিষয়ে শুনানির জন্য আজ মঙ্গলবার দিন ঠিক করা হয়।

অন্যদিকে নুসরাত হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন।

অভিযোগপত্রের ১৬ আসামি হলেন মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদরাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল।

এ মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করে পিবিআই। আদালত তা অনুমোদন করেন।

এফএইচ/এমএআর/এমএস