জাতীয়

খাদেম হানিফকে হত্যার পর আসরের নামাজ পড়তে যান সাইফুল

রাজধানীর আজিমপুর গোরস্থান মেয়র হানিফ জামে মসজিদের প্রধান খাদেমের পদ থেকে সরিয়ে আবু হানিফকে দেয়ায় পদ হারিয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন সাইফুল। দায়িত্ব পালন ও অবহেলাজনিত কারণে হানিফের সঙ্গে কথাকাটাকাটিও হয় তার। এরপর হানিফকে খুনের পরিকল্পনা করেন সাইফুল। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি চাকু কেনেন তিনি।

Advertisement

গত ২ জুলাই দুপুরের খাবার শেষ করে প্রধান খাদেম হানিফ বিকেল ৪টার দিকে মসজিদের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েন। ওই সময় কেউ না থাকার সুযোগ নিয়ে দরজা লাগিয়ে সাইফুল রান্নাঘরে রাখা চাকু নিয়ে হানিফের মুখ চেপে ধরে উপর্যুপরি বুকে, পেটে ও গলায় একাধিক আঘাত করেন। এতে হানিফের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর বাইরে থেকে প্লাস্টিকের বস্তা ও পলিথিন নিয়ে আসেন এবং মরদেহ বস্তায় ঢুকিয়ে পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে বেলকুনিতে একটি বাঁশের ঝুড়িতে রাখেন। বাথরুম থেকে বালতিতে করে পানি এনে তোশকের কভার ভিজিয়ে মেঝের রক্ত পরিষ্কার করেন।

ঠান্ডা মাথায় খুনের পর সাইফুল আসরের নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষে রক্তমাখা কাপড় বাথরুমে পরিষ্কার করেন। রাত ৯টার দিকে বাইরে খেতে গিয়ে রাত ১০টার দিকে রুমে ফিরে আসেন।

আজিমপুর গোরস্থান মেয়র হানিফ জামে মসজিদের প্রধান খাদেম আবু হানিফের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাইফুলকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতারের পর আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডির পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন পিআইবি প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

Advertisement

গত ৩ জুলাই রাতে ওই মসজিদ থেকে একটি গলিত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা চাঞ্চল্য ছড়ায়। পরে জানা যায়, ওই মরদেহ মসজিদেরই প্রধান খাদেম আবু হানিফের। ওই ঘটনার ছায়া তদন্ত করে আসছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিআইবি প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘আজিমপুর গোরস্থান মেয়র হানিফ জামে মসজিদটি গত বছরের ৪ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয়। সেদিন থেকে সাইফুল ইসলাম খাদেম হিসেবে যোগ দেন। মসজিদে আরও তিনজন খাদেম ও একজন পরিচ্ছন্নকর্মী কর্মরত ছিলেন। তবে সাইফুল সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় কর্তৃপক্ষ গত রমজানের আগে আবু হানিফকে প্রধান খাদেম হিসেবে নিয়োগ দেয়। হানিফ তার দায়িত্ব পালনকালে সাইফুলকে বিভিন্ন কাজের জন্য নির্দেশ দিতেন। কর্তৃপক্ষকে হানিফ বিভিন্ন সময় সাইফুলের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি জানাতেন। এ নিয়ে আসামি সাইফুলের সঙ্গে ভিকটিম হানিফের মনোমালিন্য দেখা দেয়।

নিহত মসজিদের প্রধান খাদেম আবু হানিফ

গত ২ জুলাই জোহরের নামাজের পরে বিকেল ৩টার দিকে হানিফ সাইফুলকে কাজ করতে বলায় সাইফুল অস্বীকৃতি জানালে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। ওই ঘটনার পরই সাইফুল পরিকল্পনা করে প্রধান খাদেম আবু হানিফকে হত্যা করেন।

Advertisement

মরদেহ বস্তায় ঢুকিয়ে পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে ঝুড়িতে রাখার পর বাথরুম থেকে বালতিতে পানি এনে তোশকের কভার ভিজিয়ে ফ্লোরের রক্ত পরিষ্কার করেন। রাত ৯টার দিকে সাইফুল বাইরে খেতে যান এবং ১০টার দিকে রুমে ফিরে আসেন।

বাহাউদ্দিন (ঝাড়ুদার) ও ফরিদ (খাদেম) বাইরে থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে রুমে ফিরে এসে জানতে চান খাদেম হানিফ কোথায়। সাইফুল জানান, তিনি বাইরে গেছেন।

পরিকল্পনা ছিল গভীর রাতে প্রধান খাদেম হানিফের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানের যেকোনো ভাঙা কবরে ফেলে দেয়া হবে। কিন্তু খাদেম ফরিদ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকায় সাইফুল সিদ্ধান্ত বদলান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি খাদেম ফরিদকে বলেন, তার বাবা মারা গেছে। এই বলে তিনি তার সব ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে চলে যান।

৩ জুলাই রাতে ক্লিনার বাহাউদ্দিন ও নতুন নিয়োগকৃত খাদেম ফরিদ নিহত খাদেম হানিফের কক্ষে ঘুমাতে যান। সেই সময় তারা দুর্গন্ধ পেয়ে পাশের বেলকোনির থাই গ্লাস টান দিয়ে একটি বাঁশের খালি ঝুড়ির মধ্যে পলিথিন দিয়ে পেঁচানো একটি বস্তা দেখতে পান। পরে সেটি খুলে তারা খাদেম হানিফের মরদেহ শনাক্ত করেন।

বনজ কুমার বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে সাইফুলের মোবাইলফোন বন্ধ ছিল। বাবা মারা যাওয়ার কথা বলে তিনি পালিয়ে যান। তিনি প্রথমে সেনবাগ নোয়াখালীতে তাদের বাড়িতে যান। পরে সেখান থেকে তার শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামের খুলশীতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় শ্বশুর আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালে রেলওয়ে হাসপাতালের কাছে চাচার কাছে যান। সেখানেও আশ্রয়ের সুযোগ না পাওয়ায় আগ্রাবাদ বেপারিকান্দি তার ফুফুর বাসায় আশ্রয় নেন। কৌশলী সাইফুল আত্মগোপনে থাকার জন্য দাড়ি কেটে ফেলেন।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) একটি বিশেষ টিম চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আগ্রাবাদ এলাকার বেপারীকান্দির ওই ফুফুর বাসার দরজা ভেঙে সাইফুলকে গ্রেফতার করে। হানিফ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা চাকুও উদ্ধার করা হয়।

পিবিআই জানায়, নিহত হানিফ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। আড়াই বছর আগে তিনি বিয়ে করেন। তার তিন মাসের একটি মেয়ে আছে।

হানিফ হত্যায় শ্বশুর জাকির শেখ (৬০) বাদী হয়ে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৬।

গ্রেফতার সাইফুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন। আজ মঙ্গলবার তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে। সেখানে ১৬৪ ধারায় হত্যার ব্যাপারে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবার কথা।

জেইউ/এসআর/পিআর