অর্থনীতি

ব্যাংকের লাভের গুড় এমডিরা খায়!

>> ব্যাংকগুলোর এমডিদের পেছনে ব্যয় ১০ কোটি টাকা

Advertisement

>> গত বছরের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ

 >> সবচেয়ে বেশি ব্যয় আল-আরাফাহ্ এমডির পেছনে 

>> সবচেয়ে কম রূপালী ব্যাংকের এমডির, মাসে ৪ লাখ

Advertisement

>> সুশাসনের অভাবেই এমন চিত্র: মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক কোম্পানিগুলো থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন। তাদের এই টাকা নেয়ার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় দেড় কোটি টাকা বেশি। 

ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছেন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের এমডি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক নেয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন >> সংকটে ১০ ব্যাংক

Advertisement

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের মধ্যে চলতি বছর ২০টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পারিতোষিক নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তবে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে খরচ কমেছে। সাতটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে খরচ অপরিবর্তিত রয়েছে। একটি ব্যাংকের (এবি ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে চলতি বছরের তিন মাসে কত টাকা খরচ হয়েছে, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।

চলতি বছরের তিন মাসে তালিকাভুক্ত ২৯টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য আগের বছরের তুলনায় খরচ বেড়েছে এক কোটি ৩৬ লাখ ৮৭ হাজার ১০৮ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ দিয়েছে নয় কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ২০১৮ সালের একই সময়ে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল আট কোটি ৫৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৭ টাকা।

বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছেন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরী। তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে তিনি ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন >> প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও আমলে নিচ্ছে না ব্যাংক

শীর্ষস্থান দখলের পাশাপাশি গত বছরের তুলনায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি বছরে ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পারিতোষিক বাবদ নেন ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে নেন ১৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের তিন মাসে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১৪ লাখ টাকা। গড় হিসাবে প্রতি মাসে বেড়েছে চার লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অবশ্য এ সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও পরিবর্তন হয়েছে।

বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পারিতোষিক বাবদ তালিকাভুক্ত ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার। চলতি বছরের তিন মাসে তিনি ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭১ টাকা। এ হিসাবে তিনি গড়ে প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২২ লাখ ২৯ হাজার ১৯০ টাকা।

চলতি বছরে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও গত বছর ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিলেন ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ৫৯ লাখ ৬১ হাজার ৪২৯ টাকা নিয়েছিলেন। অর্থাৎ গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে গড়ে প্রতি মাসে ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক থেকে নেন ১৯ লাখ ৮৭ হাজার ১৪৩ টাকা। এ হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে ব্যাংক থেকে আলী রেজা ইফতেখারের টাকা নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৭ টাকা।

আরও পড়ুন >> ব্যাংক পরিচালনায় সৎ লোক নিয়োগ করা উচিত : আপিল বিভাগ

এদিকে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পারিতোষিক বাবদ সব থেকে কম টাকা নিচ্ছেন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে তিনি নিয়েছেন চার লাখ টাকা করে। গত বছরও এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক থেকে একই পরিমাণ টাকা নেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব আছে। এরই প্রতিফল এমডিদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিকের এমন চিত্র। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। কারণ কে, কাকে এবং কত টাকা বেতন দেবে- তা যেকোনো প্রতিষ্ঠানেরই স্বাধীনতা আছে। তবে আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এমডিদের বেতন-ভাতার সর্বোচ্চ একটি সীমা বেঁধে দেয়া। 

তিনি আরও বলেন, এমডিদের মাত্রারিক্ত বেতন-ভাতা নেয়ার কারণে ব্যাংকের খরচের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রফিট (মুনাফা) কম হচ্ছে। এ কারণে আমানতকারীরা ইন্টারেস্ট কম পাচ্ছেন এবং শেয়ারহোল্ডাররা কম লভ্যাংশ পাচ্ছেন।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে খরচ বাড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- সিটি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, এক্সিম ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।

আরও পড়ুন >> ব্যাংক খাতে সংকট, ধাক্কা লেগেছে পরিচালন মুনাফায়

অপরদিকে রূপালী ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে খরচ অপরিবর্তিত থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- আইএফআইসি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে খরচ কম করা একমাত্র ব্যাংক হলো মার্কেন্টাইল।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ নিয়েছেন ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ২১০ টাকা। গত বছরের একই সময়ে এ খরচের পরিমাণ ছিল ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭১০ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের তিন মাসে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খরচ কমেছে দুই লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা।

চলতি বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে খরচ বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের। প্রতিষ্ঠনটি চলতি বছরে গত বছরের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ খরচ করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ নিয়েছেন ৩৭ লাখ টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮ লাখ টাকা।

খরচ বাড়ার হারের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ নিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পারিতোষিক বাবদ ব্যাংকটির খরচ হয়েছিল ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

ব্যাংক থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) টাকা নেয়ার চিত্র-

ব্যাংকের নাম

এমডিরা টাকা নিয়েছেন

টাকা নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে

২০১৯ (জানুয়ারি-মার্চ)

২০১৮ (জানুয়ারি-মার্চ)

সিটি ব্যাংক

৩৭,৭৪,৯৩৪

৩৭,২৯,২৬৩

৪৫,৬৭১

ন্যাশনাল ব্যাংক

২৩,৮৫,০০০

১৯,৩৫,৩৮৭

৪,৪৯,৬১৩

পূবালী ব্যাংক

৩০,০০,০০০

২৪,৭৫,০০০

৫,২৫,০০০

উত্তরা ব্যাংক

২৫,২৭,৫৬৬

২২,৭৮,৫০০

২,৪৯,০৬৬

প্রাইম ব্যাংক

২৪,১৫,০০০

২২,৫০,০০০

১,৬৫,০০০

সাইথইস্ট ব্যাংক

২৩,৫০,৫০০

২২,৪৯,৮৫৬

১,০০,৬৪৪

ঢাকা ব্যাংক

৩৯,১৫,০০০

৩২,৯৫,৫০০

৬,১৯,৫০০

এনসিসি ব্যাংক

২৮,৫০,০০০

২৭,০০,০০০

১,৫০,০০০

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক

৩৫,৬৫,০০০

৩৪,০০,০০০

১,৬৫,০০০

মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

৩৫,১৯,০০০

৩৩,৫৪,০০০

১,৬৫,০০০

ব্যাংক এশিয়া

৩৫,৪৫,০০০

৩০,৫০,০০০

৪,৯৫,০০০

এক্সিম ব্যাংক

৪৫,৫৮,৩১০

৪২,০৪,৯৬১

৩,৫৩,৩৪৯

ব্র্যাক ব্যাংক

৩৫,২৫,০০০

২৪,০০,০০০

১১,২৫,০০০

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক

৩৯,৩০,০০০

৩২,৩৭,৭০০

৬,৯২,৩০০

প্রিমিয়ার ব্যাংক

৩৭,০০,০০০

২৫,০০,০০০

১২,০০,০০০

ট্রাস্ট ব্যাংক

৩১,২৮,০৭০

২১,১৯,৪৫৯

১০,০৮,৬১১

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

৪৩,৯৭,৪৫৪

৩৪,২২,৭৪২

৯,৭৪,৭১২

এদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পারিতোষিক নেয়া বাবদ খরচ অপরিবর্তিত থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে- চলতি বছরের তিন মাসে আইএফআইসি ব্যাংকের ৩২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ২১ লাখ ৯ হাজার টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২০ লাখ ১০ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংকের ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং যমুনা ব্যাংকের ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।   

আরও পড়ুন >> সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫৩৪৩ কোটি টাকা

বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক বাবদ সর্বোচ্চ অর্থ পাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখারের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না’। বলেই তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। 

এমএএস/এমএআর/পিআর