শিপ্রা রানী দের বামপাশের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল তার দুই বছরের শিশুসন্তান। এ অবস্থায় সোমবার (৮ জুলাই) সকালে শিপ্রা রানী গলা ফাটিয়ে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘চাকরি আছে বেতন নাই, এমন কোনো দেশ নাই।’
Advertisement
নোয়াখালীর হাতিয়া থানার নলেরবর চরের বাসিন্দা শিপ্রা রানী দে। আল-আমিন বাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৩ বছর ধরে শিক্ষকতা করেন তিনি। কিন্তু জাতীয়করণ না হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো বেতন-ভাতা পাননি। ২০১৩ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করার ঘোষণা দেয়ার পর তৃতীয় ধাপেও জাতীয়করণ হয়নি শিপ্রা রানীর বিদ্যালয়। তৃতীয় ধাপেও বাদ পড়া বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ১৬ জুন থেকে ২৩ দিন ধরে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছেন।
বছরের পর বছর বেতনহীন থাকা, রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না-খেয়ে আন্দোলন করা এসব শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই এখন রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে-কষ্টে কেঁদে ফেলছেন তারা।
গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়া শিপ্রার সঙ্গে কথা বলতে গেলে কান্নাজুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২৩ দিনে আমি ৮ বেলাও ভাত খাইনি। তারপরও জাতীয়করণের আশায় ছোট সন্তানকে নিয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এখানে আছি।’
Advertisement
শিপ্রার বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে তার বিদ্যালয়। তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া যতই খারাপ থাকুক, আমি ক্লাস কামাই দিইনি। চর দিয়ে ৫ কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় বৃষ্টি আসলে খালা বলে কারো ঘরে আশ্রয় নিই, বুবু বলে আরেকজনের ঘরে আশ্রয় নিই। আমাদের কোনো নিরাপত্তা নাই। তারপরও ক্লাস বাদ দিই না।’
সেখানে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই বলেও জানান শিপ্রা রানী। তারপরও তাদের বেসরকারি বিদ্যালয়টি সরকারি করছে না বলেও অভিযোগ শিপ্রার।
কান্নার কষ্টে কখনও কখনও স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারছিলেন না বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষিকা। শিপ্রার মতোই নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে শত মানুষের সামনেও কান্না চাপা রাখতে পারেননি রেবেকা সুলতানা। তার কোলেও ছিল ১ বছর ২ মাসের শিশুসন্তান মো. আব্দুল্লাহ রায়হান।
Advertisement
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা সদরের পশ্চিম খাজুরা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০০ সাল থেকেও শিক্ষকতা করে আসলেও তিনিও কোনো বেতন পাননি। গত ২৩ দিন ধরে তিনিও প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন।
এসব কথা বলতে গিয়ে কান্না থামাতে পারেননি রেবেকা সুলতানা। তিনি বলেন, ’আমি ১৮ বছর শিক্ষকতা করলাম, কিন্তু একটা টাকা পেলাম না। আমার স্বামী গাড়ি দুর্ঘটনার পর থেকে ঘরে বসা। বড় ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। এ বছর এখন পর্যন্ত ওর স্কুল ড্রেস কিনে দিতে পারি নাই।’
রেবেকা ও শিপ্রা রানীর সঙ্গে কথা বলার পর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যেঁচে কাছে আসেন নেত্রকোনা সদরের শালজান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অকিল পাল। ছলছল চোখে তিনি বলেন, ‘বাবা, আর দুই বছর পর অবসরে যাব। কিন্তু এখনও তো কোনো বেতন পেলাম না।’
বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে তারা এ আন্দোলন করছেন। সমিতির মহাসচিব মো. কামাল হোসেন জানান, খোলা আকাশের নিচে এভাবে আন্দোলন করতে গিয়ে গত ২২ দিনে ১৮১ জন শিক্ষক-শিক্ষা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
২৩ দিন আন্দোলনের মধ্যে গত ৬ দিন ধরে তারা আমরণ অনশন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর তৃতীয় ধাপেও বাদ পড়া এসব বেসরকারি বিদ্যালয় জাতীয়করণ না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকলেও বলেও জানান আন্দোলনকারী শিক্ষকরা।
পিডি/এমআরএম