আইন-আদালত

রাজাকার মুসা ওরফে ফিরোজ খাঁর রায় যেকোনো দিন

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার কুখ্যাত রাজাকার আব্দুস সামাদ ওরফে ফিরোজ খাঁ ওরফে মুসার রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।

Advertisement

রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সোমবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। আজ (সোমবার) সর্বশেষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষের পর রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।

আসামির বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) প্রসিকিউশনের ১৫ জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি পেশ করেন। অন্যদিকে আসামির পক্ষে কোনো সাফাই (ডিফেন্স) সাক্ষী ছিল না।

Advertisement

আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ ও প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম। আসামির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।

প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা শেষ হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে আজ শেষ হলে আদালত মামলাটির রায় অপেক্ষমাণ রেখে আদেশ দেন। অর্থাৎ রায় যেকোনো দিন ঘোষণা করা হবে।‘

আসমিপক্ষের আইনজীবী সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘উভয় পক্ষের মধ্যে এটা মূলত জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আদালতে সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে করি। তাই আসামির খালাস চেয়েছি।’

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পুঠিয়ার বাঁশবাড়ী এলাকার মৃত আব্বাস আলীর ছেলে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ মুক্তিযুদ্ধের আগে মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে শান্তি কমিটির স্থানীয় নেতার নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।

Advertisement

তদন্ত প্রতিবেদনে আসামি ফিরোজ খাঁর বিরুদ্ধে চারজন সাঁওতালসহ ১৫ জনকে হত্যা, ২১ জনকে নির্যাতন, ৮ থেকে ১০টি বাড়িঘর লুণ্ঠনসহ ৫০ থেকে ৬০টি বাড়িঘর অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে দেয়।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে পুঠিয়া থানার ভালুকগাছী ইউনিয়নের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে আসামি ফিরোজ খাঁ, পাকিস্তানি আর্মি ও তার সহযোগিরা স্বাধীনতার পক্ষের হেমব্রম, কানু হাসদা, জটু সরেন ও টুনু মাড্ডিকে তরবারি দিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।

২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্ত শুরু হয়। তখন এ মামলায় আসামি করা হয়েছিল ছয়জনকে। কিন্তু তদন্ত চলার সময়ই বাকি পাঁচ আসামির মৃত্যু হলে একমাত্র আসমি হিসেবে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁই থাকেন।

তদন্ত চলার সময় নাশকতার মামলায় গ্রেফতার হন এ আসামি। পরে ২০১৭ সালে ২৪ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তার পূর্বপুরুষরা ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে আসা। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পালিয়ে যান।

মামলার বিবরণ সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমভাগ ও গোটিয়া গ্রামে আদিবাসী ও বাঙালিদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালান আব্দুস সামাদ মুসা ওরফে ফিরোজ খাঁ ওরফে মুসা রাজাকার। এ সময় তার নেতৃত্বে সেখানে চলে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। তার বিরুদ্ধে মামলা করেন মুসার হাতে নিহত পশ্চিমভাগ গ্রামের শহীদ আবদুস সামাদের স্ত্রী রাফিয়া বেওয়া। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধের তদন্ত শুরু হয়।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসার বয়স ছিল ২০ থেকে ২২ বছর। ওই বয়সে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে এলাকার যুবকদের নিয়ে দল গঠন করেন।

১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুঠিয়া আক্রমণ করে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে মুসা হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। ১৯ এপ্রিল তিনি ৩০-৪০ জন হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে বাঁশবাড়িয়া গ্রামে যান। সেখানে তারা ২১ জনকে আটক করেন। তাদের নিয়ে রাখা হয় গোটিয়া গ্রামের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বাড়িতে। সেখানে দিনভর নির্যাতন করে ১৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। হত্যা করা হয় চারজনকে।

পুঠিয়ার দুর্গাপুরে তার নির্দেশে তাদের গুলি করে মারা হয়। এরপর মুসার নির্দেশে পশ্চিমভাগ মাদরাসার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় আক্কেল আলীর ছেলে আবদুস সাত্তারকে।

মুসা পশ্চিমভাগ সাঁওতাল পাড়ার ধনাঢ্য আদিবাসী লাডে হেমব্রমের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেন।

এফএইচ/এসআর/এমএআর/এমকেএইচ/এমএস