খেলাধুলা

মাশরাফিরও আছে অবসরের অধিকার

এরকমই হয়। চিরটা কাল। অতীতে হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। আসন্ন বিদায়ের অনুভূতি চারপাশটা কেমন ঝাপসা করে দেয়। চোখে ঘনিয়ে তোলে অনামী ব্যথার বাষ্পকণা। মাশরাফি যে কাল লর্ডসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন না, সে তো এই কারণেই। সেই মাশরাফি, সাংবাদিকদের সঙ্গে যার চিরকালীন একটা প্রাণস্পর্শী সম্পর্ক। সেই মাশরাফি এক অদ্ভুত সহজাত ক্ষমতায় যিনি সামলাতে জানেন সাংবাদিক সমাজকে।

Advertisement

সাংবাদিকদের সামনে গেলেই তাঁকে বিশ্বকাপে নিজের ম্যাচটি নিয়ে কথা বলতে হতো। ভীড় করতে কত স্মৃতি আর আবেগের কোলাজ। সামলাতে হতো অপ্রিয় বাস্তবতার বেমক্কা কিছু বাউন্সার। এমন তো নয় যে, ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে না গেলে পৃথিবী শেষ হয়ে যেত।

সময় তো পড়ে রয়েছেই। ম্যাচটা শেষ করেই না হয় কথা বলা যাবে। মাশরাফিকে যেমন বুঝি, এর মধ্যে একটি পেশাদারি দিকও রয়েছে। ম্যাচের আগেই আবেগ যাতে তাকে নাড়িয়ে না দেয়, সেটির বিরুদ্ধেই সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। আগে থেকেই ‘বিদায়’ ‘বিদায়’ রব উঠতে থাকলে পাথর–হৃদয় মানুষের মধ্যেও আবেগটা কেমন ছলকে ওঠে।

আর তিনি তো একজন ক্রিকেটার। এরকম সময় একজন ক্রিকেটার মাঠে গিয়ে তো বল হাতে নেন না, নেন যেন কান্নার দলা। ২২ গজে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে সাদা চামড়ার একটি বল তো দেখেন না, দেখেন ব্যথার পিণ্ড। ফিল্ডিং করবেন কী, সবুজ ঘাসকে মনে হয় রুপোলি জলের ঢেউ। মাশরাফি তা হতে দিতে চাননি। স্তুতিতে ভরা মানপত্র নয়, পাকিস্তানের বিপক্ষে জীবনের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে জয়ই উপহার পেতে চেয়েছেন, যাতে তার নিজেরও থাকবে অংশীদারি।

Advertisement

এই বিশ্বকাপটা শেষ পর্যন্ত আমাদের মনের মতো হলো না। মনের মতো বলতে, বিশ্বকাপ যাত্রার আগে আঁকা আমাদের স্বপ্ন–সংলগ্ন নয়। আমরা ভেবেছিলাম, মাশরাফিরা সেমিফাইনালে যাবেন। ক্রিকেটের পৃথিবীকে উচ্চস্বরে বলবেন, দেখো আমরা আমাদের সামর্থ্যের বায়বীয় বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করি না। সেমিফাইনালে উঠে আমাদের ক্রিকেটোন্নতির প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করলাম। আগের বিশ্বকাপে আমরা সেরা আট দলের একটি হয়েছিলাম। এবার সঙ্গত দাবি নিয়েই কম করে হলেও সেরা চার দলের একটি হতে চেয়েছি। সেটি হলো না সামান্যর জন্য। সবকিছু মিলিয়েই। বড় সাফল্যের উৎসমুখে ভাগ্যের একটু ছোঁয়া লাগে। সেটি আমাদের বিমুখ করেছে। ছিল কিছু ভুল। ছিল সামর্থ্যহীনতারও সামান্য প্রকাশ।

অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দৃষ্টি ফেললে একটি বড় গোষ্ঠীর যে মত পাওয়া যায়, তাতে মনে হবে এই ব্যর্থতার পেছনে মাশরাফির ভূমিকাও অনেক বড়। এক ইংল্যান্ড ম্যাচ ছাড়া তিনি নিজের ১০ ওভার বোলিং কোটা পূরণ করতে পারেননি, মানে প্রতিপক্ষের ব্যাটে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে পূরণ করতে চাননি। অর্থাৎ পালিয়ে গেছেন।

দলের পেস বোলিংয়ের প্রধানতম মুখ, অথচ নিতে পেরেছেন একটি মাত্র উইকেট। ব্যাটের হাতটা একেবারেই এলেবেলে মার্কা ছিল না; কিন্তু ব্যাট হাতে তার অবদান মাত্র ১৯ রান। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে জয়ের শেষ চেষ্টাটা করে দেখার আশায় সাইফউদ্দিনের দাপুটে ব্যাটিংকে সমর্থন দিতে পারেননি। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ দলের সাফল্যে মাশরাফির অংশীদারিত্ব নেই। এগোরো জন নয়, বাংলাদেশ ম্যাচ খেলছে দশজনের দল হিসেবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে চাইলে পাত্তা দিতে পারেন, নাও পারেন; কিন্তু এ কথা তো অস্বীকার করতে পারেন না যে এ হলো মানুষের মুখ। সেই মুখ আপনি বন্ধ রাখতে পারেন না। একবিংশ শতাব্দীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আবির্ভাব মানুষের মতামত গঠন, সমালোচনা, গুঞ্জন বা ফিসফিসানি যাই বলুন না কেন সে সবের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। এটি না থাকলে আপনি হাটে–মাঠে–ঘাটে যেখানেই যেতেন কথা শুনতে হতো।

Advertisement

আপনি ব্যক্তি হিসেবে হয়তো একেবারেই স্বাধীন সত্তা, কিন্তু যখন দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তখন সবার। সারা দেশের মানুষের চাওয়া–পাওয়ার হিসেব তখন মেলাতেই হয়। রাজনীতির প্রবল এক ধারায় বিভক্ত এই দেশে তো সেটি বেশি করেই। মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে ভাবি, যে রাজনৈতিক ধারা আমাদের একদা মহা ঐক্যের প্রতীক, মহান স্বাধীনতার জন্মদাতা, সেই ধারায় মিলিত হয়ে মাশরাফি সংসদ সদস্য হয়েছেন, আর সে জন্যই কিনা সমানভাবে এখন তাকে ঘৃণাও কুড়োতে হচ্ছে। এ সবকিছু বিবেচনায় নিয়েও আমি বলব, এই বিশ্বকাপে যতটা সাফল্যই অর্জিত হোক, তাতে মাশরাফির অংশীদারিত্ব আছে।

পঁয়ত্রিশ বছরের শরীর বহু আঘাতে জীর্ণ, দু’পায়ের হাঁটু ও অ্যাংকেল মিলিয়ে সাতটি অস্ত্রোপচারের ধকল সয়েছে। সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগ অসম্ভব। তবু বিশ্বকাপ অভিযানে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির বিকল্প তো খুঁজে পায়নি বাংলাদেশের ক্রিকেট–সংসার। শুধু আবেগের মূল্য দিতেই তাকে একাদশে রাখা, ব্যাপারটি মোটেও সত্যি নয়।

গত বিশ্বকাপেও অন্যতম সেরা ছিলেন, এই বিশ্বকাপেও তিনি অন্যতম সেরা অধিনায়ক। এই অধিনায়কত্বের বিষয়টি আসলে মেধাস্বত্ব। এটি বাজারে সের দরে কিনতে পাওয়া যায় না। বিদ্যুচ্চমকের মতো এখনো আমার চোখে আলো ছড়িয়ে যায় ২৪ জুন সাউদাম্পটনে আফগানিস্তান ম্যাচে মাশরাফির অধিনায়কত্ব।

আফগানিস্তানের সঙ্গে জয়ে আমাদের অর্জনের খাতাটা ভারী হয় না ঠিকই, কিন্তু পরাজয়ে লজ্জার কাঁটা শরীরে নিতে হয়। আর কী দুর্দান্ত অধিনায়কত্ব করেই না মাশরাফি সেদিন জেতালেন বাংলাদেশকে। কোনো সুযোগই দেননি আফগানদের।

গুলবদিন নাইব ও মোহাম্মদ নবী একটি জুটি গড়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দিতে শুরু করেছিলেন, কুশলী অধিনায়ক সিলি পয়েন্ট এবং পরে শর্ট এক্সট্রা কভারে ফিল্ডার হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন সাহসী লিটন দাসকে। হাঁসফাঁস করতে লাগলেন দুই আফগান ব্যাটসম্যান। সাকিবের বাঁ-হাতি স্পিনে শেষ পর্যন্ত তাঁদের উইকেট দিতেই হলো।

বিশ্বকাপের এ পর্যন্ত ফিল্ডিংয়ের সেরা চাল মনে হয়েছে এটিকে। আর এটি প্রমাণিত যে বাংলাদেশের ইতিহাসে মাশরাফি সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী অধিনায়ক। বিশ্বাস না হয়, দলের প্রতিটি খেলোয়াড়কে আলাদা করে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সবার মুখেই অভিন্ন উত্তর পাবেন।

শুধু অধিনায়কের জন্য হলেও তাঁরা নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে চান। এই গ্রহে সহখেলোয়াড়দের মন জিতে নেওয়া এরকম কয়টি ক্রিকেট অধিনায়কের সন্ধান আপনি পেয়েছেন?

বাংলাদেশের সেই অধিনায়ক আজ বিশ্বকাপকে বিদায় বলছেন। বিদায়ের মঞ্চটাও ঘটনাচক্রে বাঁধা হয়েছে যথার্থ জায়গায়। ক্রিকেট তীর্থ লর্ডস! যে কোনো ক্রিকেট–বীরের কাছেই যেটি স্বপ্নের মতো।

আগামী বিশ্বকাপে তার বয়স হতো উনচল্লিশ। চোটে জর্জরিত না হলে হয়তো ক্রিস গেইলের মতো ওই বিশ্বকাপেও জনদাবি থাকত তিনি খেলুন। সে আর সম্ভব নয়, শরীর সাড়া দেবে না। ক্যারিয়ারেরই গোধূলি বেলায় তিনি দাঁড়িয়ে।

ক্রিকেট থেকে এখনই অবসরের ঘোষণা অবশ্য দেননি। কেন দেবেন? দেশের মাটিতে ভরা গ্যালারির সামনে ফুলের মালায় শোভিত বিদায় চেয়ে নেওয়ার অধিকার তো তার আছে। সেই অধিকার অর্জন করেছেন দেশের জন্য অজস্র জয়ের মুহূর্ত গড়ে, একটি রুগ্ন ক্রিকেট সভ্যতায় প্রাণ সঞ্চার করে

আইএইচএস/এমকেএইচ