ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বাহরাইনের রাজধানী মানামায় তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার ‘শান্তির জন্য সমৃদ্ধি’ নামক এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন গত সপ্তাহে। ইহুদিদের সন্তান তিনি। আবার ট্রাম্পের মেয়ের জামাতা। সর্বোপরি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত বন্ধু। নেতানিয়াহু আমেরিকা সফরের গেলে কুশনারের বাসায়ও আতিথ্য গ্রহণ করেন। নেতানিয়াহু কুশনারের সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনিদের সব দাবি উপেক্ষা করে একটি একক কর্তৃত্বে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
Advertisement
কুশনারের সহায়তায় নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইসরাইল রাষ্ট্রের ক্রীড়নক বানিয়েছেন। এখন ট্রাম্প ইহুদি রাষ্ট্রের সব কিছুতে বৈধতা দিচ্ছেন। জেরুজালেম ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছিল জর্দানের অংশ। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জর্দানের জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান মালভূমি আর মিসরের গাজা ও সিনাই ইসরাইল দখল করে নিয়েছিল। জাতিসংঘ এই তিন এলাকা তিন রাষ্ট্রকে ফেরত দেওয়ার জন্য ইসরাইলকে বলেছিল। এই মর্মে জাতিসংঘে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল কিন্তু ইসরাইল তা ফেরত দেয়নি।
এখন ইসরাইল জেরুজালেমকে রাজধানী করেছে। ট্রাম্প তা মেনে নিয়েছেন এবং তেল আবিব থেকে তার দূতাবাস জেরুজালেমে নিয়ে এসেছেন। অথচ ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া, জার্মানি- কেউই তাদের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে আনেনি।
গোলান মালভূমিতে ইহুদিরা এখন বসতি স্থাপন করছে এবং গোলান ইজরাইলের জায়গা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন ট্রাম্প। শুধু মিসরের সঙ্গে আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরাইলের যে চুক্তি হয়েছে তার শর্তানুসারে গাজা ফিলিস্তিনিদের বসতি করার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর সিনাইকে মিসরের কাছে ইসরাইল প্রত্যর্পণ করেছে।
Advertisement
গাজা পূর্ব থেকেই ফিলিস্তিনের ছয় জেলার এক জেলা ছিল। জেরুজালেমও ফিলিস্তিন ছয় জেলার এক জেলা। জর্দান জেরুজালেম ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনকে দিয়ে দিয়েছে, যদিওবা ওই এলাকা তার অধিকার নেই। ২৫-২৬ জুন বাহরাইনের রাজধানী মানামায় যে সম্মেলন ডাকা হয়েছিল তাতে ফিলিস্তিন যোগ দান করেনি বরঞ্চ ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কুশনার মানামায় ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন তাতে ফিলিস্তিন ইসরাইলের মধ্যে সংকট সমাধানে কোনও রাজনৈতিক ইস্যু নেই।
গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিবাদমান পক্ষগুলোকে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। কুশনার জানিয়েছেন, ট্রাম্প পরিকল্পনার রাজনৈতিক অংশ পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করবেন। মানামায় ট্রাম্পের ইচ্ছায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কুশনার বলেছেন, শান্তির জন্য সমৃদ্ধির পরিকল্পনার আওতায় ফিলিস্তিন এবং তার আশপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোতে আগামী দশ বছরে পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হবে।
এক হোটেলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কুশনার আরও বলেন, বিনিয়োগকৃত এই অর্থ দিয়ে রাস্তা ঘাট, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সীমান্ত উন্নয়ন ও পর্যটনের নানা খাতের উন্নয়ন হবে। এবং লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনির কর্মসংস্থান হবে দাতা দেশগুলোতে। এ অঞ্চলে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। দাতা দেশগুলো হচ্ছে আরব অঞ্চলের ধনী দেশগুলো। পাঁচ হাজার কোটি ডলারের মাঝে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা অর্থাৎ যেখানে বর্তমান ফিলিস্তিনিরা বসবাস করে সেখানে দুই হাজার আট শত কোটি ডলার দেয়া হবে। জর্দানকে দেয়া হবে ৭০০ কোটি ডলার, ৯০০ কোটি ডলার দেয়া হবে মিসরকে এবং ৬০০ কোটি ডলার দেয়া হবে লেবাননকে।
হামাস আর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ কুশনারের এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, ইসরাইলের সঙ্গে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হলে তারা আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে তাদের এলাকায় উন্নয়নের জন্য এরচেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। আর এমন কাজের জন্য কুশনার ও ট্রাম্পের কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। গাজা ইহুদিদের কোনও বসতি নেই কিন্তু জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে তো ইহুদি আর ফিলিস্তিনিদের মিশ্র বসতি। আরব দেশগুলো থেকে চাঁদা তুলে সবাইকে সেই অর্থ বণ্টন করে হাতে রাখার এবং তাদের এই পরিকল্পনার সঙ্গে রাখার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। এটাকে বলে পরের ধনে পোদ্দারি।
Advertisement
গত কয়েক দশকব্যাপী আমেরিকা ফিলিস্তিন ও ইসরাইল রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করে আসছিল। তার ভিত্তি ছিল দুই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা এবং তার একটি কাঠামোও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হচ্ছেন এই পরিকল্পনা বিরোধী। তিনি ইসরাইল রাষ্ট্রের অধীনে ফিলিস্তিনিদের কিছু স্বায়ত্তশাসন দিতে সম্মত এবং তাদের কোনও সেনাবাহিনী থাকবে সেটি নেতানিয়াহু স্বীকার করতে নারাজ।
নেতানিয়াহুর এই একরোখা পরিকল্পনার কথা ইহুদীদের অনেকে মানতে নারাজ যে কারণে গত নির্বাচনে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ৩৫ আসন পাওয়ার পরও সরকার গঠন করতে পারেনি। কারণ কোনও দল তার সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে নারাজ। ইসরাইলে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্ষণশীল দল রয়েছে যারা ৫ থেকে ৭টির উপরে আসন পায় না। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোকে নিয়েই নেতানিয়াহু কোয়ালিশন সরকার গঠন করে আসছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর ক্ষুদ্র দলগুলো তার সঙ্গে কমিশন গঠন করতে সম্মত হয়নি। যে কারণে ইসরাইলে পুনরায় নির্বাচন হবে। নেতানিয়াহু এখন ক্ষমতায় আছে অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে।
আরবদের থেকে অর্থ নিয়ে ইসরাইল ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের বিরোধ মেটানোর চেষ্টা ট্রাম্পের কূটনৈতিক ছেলেখেলার প্রয়াস, যা কখনো সফল হবে না। পূর্বের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট দুই রাষ্ট্রভিত্তিক যে সমাধানের পথে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাই ছিল সঠিক প্রয়াস। জিমি কার্টার, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামার প্রচেষ্টা ছিল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে। অবশ্য তারা তিনজন ছিলেন ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল হচ্ছে ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের অধীনে কখনো ফিলিস্তিনিরা থাকতে পারবে না কারণ তারা অন্য ধর্মে বিশ্বাস করে।
ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বলেছে যে তারা আর আমেরিকার মধ্যস্থতা মানবে না। কারণ আমেরিকা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। ট্রাম্প আর নেতানিয়াহুর সময়ে পূর্বের অগ্রগতি সব ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান আপাতত স্থগিত হলো। হয়তোবা পুনরায় গোলযোগের সূত্রপাত হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত ইহুদীরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে চেষ্টা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিন সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। হেনরি কিসিঞ্জার ইহুদিদের সন্তান। তিনিও বলেছেন সমঝোতা ছাড়া রাষ্ট্রটিই টিকবে না। এসবই ট্রাম্প, কুশনার এবং নেতানিয়াহুর ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম