৮৬ বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বিরুদ্ধে করা মামলা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের পরও নির্দেশ অমান্য করে ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। তবে বিচারক বুধবার হাইকোর্টে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে মৌখিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
Advertisement
এদিকে হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন করে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনার দায় পেশকারের ওপর চাপিয়েছেন ওই বিচারক। আগামী ১৭ জুলাই এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করার নির্দেশনা দিয়ে বিচারক মো. আল মামুন ও সংশ্লিষ্ট আদালতের এপিপি শাহাবুদ্দিন মিয়াকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়।
বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
শুনানির শুরুতেই আদালত বলেন, একজন বৃদ্ধা নারী ১৮ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। তিনি বলছেন- আমাকে জেলে দেন না হলে মুক্তি দেন। আর হাইকোর্ট থেকে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। রেকর্ডে হাইকোর্টের আদেশের সেই তথ্যও রয়েছে তারপরও মামলার শুনানির জন্য পরবর্তী তারিখ ঠিক করা হয়েছে, এটা দেখবে না।
Advertisement
আদালত আরও বলেন, গত ৩০ এপ্রিল এই মামলার বিচার কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। তারপরও বিচারিক আদালতে রেকর্ডে মামলাটি সাক্ষীর জন্য রাখা হয়। এখানে হাইকোর্টের আদেশকে ইগনোর (অবজ্ঞা) করা হয়েছে। হাইকোর্ট থেকে একজন আইন কর্মকর্তা ওই বিচারকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি কো-অপারেট করেননি। এটা খুবই দুঃখজনক।
বিচারক মো. আল মামুনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, আপনারা বিচার বিভাগের অংশ। আপনাদের সুনাম মানে বিচার বিভাগের সুনাম, আর আপনাদের দুর্নাম মানে বিচার বিভাগের দুর্নাম। হাইকোর্ট বলেন, জেলা জজ হোক আর সহকারী জেলা জজ হোক তাদের কোর্টে অনেক মামলা। আমাদের কোর্টেও অনেক মামলা। তবে কাজের চাপের কারণে তাদেরকে আমরা ডাকি না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্টের আদেশ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না।
এ পর্যায়ে শুনানিতে বিচারক আল মামুনের আইনজীবী এএম আমিন উদ্দিন বলেন, নিম্ন আদালতে রেওয়াজ হয়ে গেছে যে, পেশকার আদেশ লিখে বিচারকের সামনে ধরলে বিচারক স্বাক্ষর করেন। এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এ কারণেই হয়তো ভুলটি হয়েছে। পেশকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাকে শোকজ করা হবে।
এ সময় আদালত বলেন, আপনারা দেখবেন যৌতুকের দাবিতে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় যৌতুকের অভিযোগ প্রমাণ না পেয়ে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা বিচার শেষ করছে। এ সময় অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন বলেন, পারবে যদি দুটো (যৌতুকের দাবি ও হত্যার অভিযোগ) একসঙ্গে প্রমাণ থাকে। এ সময় আদালত বলেন, নারী-শিশু আদালত থেকে যৌতুকের দাবি প্রমাণ না পেয়েও শুধুমাত্র হত্যার অভিযোগে রায় দিচ্ছে এমন জজকে বারবার জানানো হয়েছে। অথচ এটা তাদের (নারী শিশু আদালতের) না দায়রা জজ আদালতের কাজ।
Advertisement
তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, মাননীয় আদালত আমরা আইনজীবীরা পিয়ন-ক্লার্কদের এক বিষয়ে বললে অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না। ভুল করে ফেলে, পরে দেখা গেছে আদালতের কাছে ভুল ধরা পড়ে। সেখানেও (বিচারিক আদালতে) তো মামলার অনেক চাপ।
এ সময় আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, সিচুয়েশন (পরিস্থিতিটা) এমন আপনারা এসেছেন। মামলার চাপ আছে, আমাদেরও চাপ আছে।
এর আগে আইনজীবী মো. আশলাফুল আলম নোবেল, আসামি রাবেয়া খাতুনের জাতীয় পরিচয়পত্র আদালতে উপস্থাপন করেন। সেখানে তার জন্ম তারিখ ১৯৩৩ সাল লেখা রয়েছে। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি আটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. শাহীন উপস্থিত ছিলেন।
এ পর্যায়ে এ মামলার অপর আসামি জুলহাস মারা যাওয়ার বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার অফিস থেকে কোনো প্রতিবেদন না আসায় পরবর্তী শুনানির দিনে রিপোর্ট দাখিল করতে বলেন আদালত। পাশাপাশি বিচারক ও এপিপিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়।
আদেশের পর রাবেয়ার আইনজীবী আশরাফুল আলম নোবেল সাংবাদিকদের বলেন, বৃদ্ধা রাবেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চলমান একটি মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত করার পরও মামলা পরিচালনা করায় ওই বিচারককে তলব করেছিলেন আদালত। তলবে ওই বিচারক ও এপিপি আদালতে উপস্থিত হয়ে তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করে আপাতত সাময়িক অব্যাহতি পেয়েছেন।
তিনি বলেন, তাকে হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘনের বিষয়ে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এ মামলার আরেক আসামি জুলহাস মিয়া মারা গেছেন কিনা সে বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার প্রতিবেদন দাখিল না করায় আগামী ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
নিম্ন আদালতের আদেশ লেখার বিধান কী বা বিচারিক আদালতের আদেশ লেখেন কে? জানতে চাইলে রাবেয়ার আইনজীবী আশরাফুল আলম নোবেল সাংবাদিকদের বলেন, বিচারিক (নিম্ন) আদালতের আদেশ লেখেন পেশকাররা, পরে সেটা দেখেন জজসাহেবরা। সেটা দেখে কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে বিচারক স্বাক্ষর করেন।
আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালতের অনেক আগের কাস্টম হলো পেশকার আদেশ লেখেন। কাস্টমই আইন। পেশকারদের হয়তো একটু অসাবধানতা ছিল।
জানা গেছে, বিচারিক আদালতে আসামিদের সমন জারি, সময়ের আর্জি, হাজিরা, জেলহাজত থেকে উপস্থিত হওয়াসহ ছোটখাটো বিষয়ে অর্ডার থাকলে পেশকাররা এসব প্রস্তুত করে দেন, আর জজরা তা ঠিক করে দেন।
অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগের রায় লেখার বিষয়ে আইনজীবী আশরাফুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্টের আদেশ বা রায় লেখার বিধান হলো বিচারপতি নির্দেশনা দেবেন আর বেঞ্চ অফিসার (বিও) লিখবেন। পরে সেই রায় বা আদেশের ত্রুটিবিচ্যুতি দেখে ঠিক করে স্বাক্ষর করেন বিচারপতিরা।
এফএইচ/বিএ