নারী ও শিশু

জন্মনিয়ন্ত্রণে এখনও অনাগ্রহী স্বল্প আয়ের মানুষেরা

রাবেয়া বেগম। বয়স প্রায় ২৯। এই বয়সে পাঁচ সন্তানের মা তিনি! দুপুরের দিকে ৯ মাস বয়সী সন্তানকে কোলে নিয়ে তেজগাঁওয়ের তিব্বত বস্তির রাস্তায় বসে আছেন। দেখতে মোটা হলেও দীর্ঘদিন ধরে শারীরিকভাবে দুর্বল।

Advertisement

তার কোনো সন্তান এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। জমজ সন্তান মাসুদ ও মাসুমের বয়স ১৫ বছর। কিন্তু সবচেয়ে ছোট ছেলে শরীফের বয়স ৯ মাস। রাবেয়া বেগমের ১১ বছর বয়সী মেয়ে ফারাবি খাতুন (৪র্থ সন্তান) ছাড়া বাকি সবাই এক বছরের ব্যবধানে জন্ম নিয়েছে। তৃতীয় সন্তান জন্মের তিন বছর পর মেয়ের জন্ম দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ৯ বছর বয়সী আরিফের জন্মের আট বছর পর তার সবচেয়ে ছোট সন্তান জন্ম নিয়েছে।

খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয় রাবেয়া বেগমের। পারিবারিকভাবে গর্ভনিরোধক নিয়ে কখনোই সতর্ক ছিলেন না। তাই তিনি এর ব্যবহারও করতেন না। ফলে তার বেশিরভাগ সন্তানই এক বছরের ব্যবধানে জন্ম নিয়েছে।

গর্ভনিরোধক না নেওয়ার পেছনে কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে রাবেয়া বেগম বলেন, বিয়ের পর তিন মাস তিনি পিল খেয়েছেন। কিন্তু তার স্বামী মো. মোতালেব মিয়া নিষেধ করছেন। এমনকি তার শ্বশুর-শাশুড়ি পর্যন্ত তাকে এ বিষয়ে নিষেধ করেছেন।

Advertisement

তিনি বলেন, যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, এটা সম্পর্কে জানতাম না। আমার স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি বিশ্বাস করেন আল্লাহ আমার সন্তানদের লালন-পালন করবেন। অন্যদিকে তারা বলেন, গর্ভনিরোধক নিলে আমি কোনো কাজ ঠিকভাবে করতে পারব না। সুতরাং গর্ভনিরোধক নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

নিজের জীবনকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাবেয়া বেগম বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। 

তিনি আরও বলেন, মাঝে মাঝে আমি অসুস্থবোধ করি। মনে হয় যেন হাত-পা পুড়ে যাচ্ছে, দুর্বল লাগে, মাথাব্যথা করে, কোনো ভারী কাজ করতে পারি না। 

পেশায় রাজমিস্ত্রি হওয়ায় সন্তানদের পড়ালেখার খরচ ঠিকভাবে বহন করতে পারেননি রাবেয়া বেগমের স্বামী।

Advertisement

একই বস্তিতে থাকেন ৪০ বছর বয়সী মনোয়ারা খাতুন। তিনিও গর্ভনিরোধক সম্পর্কে সতর্ক নন। মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তার। বর্তমানে পাঁচ সন্তানের জননী। তার বড় ছেলে সুমনের বয়স ২২ বছর এবং ছোট ছেলে রমজান ৭ বছর বয়সী। যদিও তার দ্বিতীয় সন্তান আলামীন (১৬) এবং তৃতীয় সন্তান মাহমুদা (১১) পাঁচ বছরের ব্যবধানে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু তার বাকি দুই সন্তান ইয়াসিন (৯) এবং রমজান (৭) দুই বছরের ব্যবধানে জন্ম নিয়েছে।

মনোয়ারা খাতুন বলেন, আমার সন্তান ইয়াসিনকে জন্ম দেয়ার পর আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কোনো এনজিও আমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত আমি গর্ভনিরোধক নিয়ে সতর্ক ছিলাম না। আমার স্বামী একজন চা দোকানদার; হাসপাতালে যাওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের কখনোই ছিল না।

শুধু রাবেয়া বেগম এবং মনোয়ারা খাতুন নন, বস্তির অধিকাংশই গর্ভনিরোধক নিয়ে সতর্ক নন। তেজগাঁও, তিব্বত, মালিবাগ, কড়াইল ও কিছু ফুটপাতে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশই গর্ভনিরোধক সম্পর্কে ধারণাই রাখেন না।

ক্লিনিক্যাল সার্ভিস ডেলিভারি প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. নুরুন নাহার বেগম রোজী বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় পারি জমাচ্ছে। তাদের অনেকেই ভাসমান জনসংখ্যার অংশ হয়ে উঠছে, যাদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন।

তিনি আরও বলেন, কিছু মানুষ এখনও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। যদিও আমরা চেষ্টা করছি, তবে আমাদের এ সেক্টরে আরও কাজ করতে হবে।

মৌচাকের সূর্যের হাসি ক্লিনিক পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, কিছু মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে সেখানে নিয়মিত আসেন। সেলিমা রহমান, একজন গৃহিণী, পাঁচ বছরের বাচ্চা নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, বিয়ের পরই তিনি সূর্যের হাসি ক্লিনিক থেকে পরিবার পরিকল্পনা পরামর্শ নিয়েছেন। 

তিনি বলেন, আমরা দু'টির বেশি সন্তান নেব না। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তারা (ক্লিনিক) আমাকে সহায়তা করেছেন। যদি আমরা এ ব্যবস্থা গ্রহণ করি তবে চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমার এবং সন্তানের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে আমি এ ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে গর্ভনিরোধক সামগ্রি না থাকায় তারা সেবা দিতে পারছেন না।

ক্লিনিক ম্যানেজার নাসিমা আক্তার জানান, ক্লিনিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তিন মাস ধরে আমরা গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা দিতে পারছি না। গর্ভনিরোধক পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি থাকায় সবাইকে সেবা দিতে পারছি না। গত তিন মাসে ১১০ জনকে সেবা দিয়েছি, যা আগে প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০ জন ছিল। 

তিনি আরো বলেন, আমরা আমাদের ক্যাম্পেইন চালু রেখেছি কিন্তু ঘরে ঘরে যাওয়ার ক্যাম্পেইন আগের মতো হয় না।

ক্লিনিকের একজন কম্পাউন্ডার বিলকিস আক্তার বলেন, ঢাকায় জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো কর্মব্যস্ততা। দিনমজুর বা গার্মেন্ট ওয়ার্কাররা তাদের কাজ নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। আমাদের কথা শোনার মতো সময় তাদের নেই। টেলিভিশনে দেয়া বিজ্ঞাপনও এখন আর কেউ দেখে না! কারণ এখন আর বিটিভি কেউ দেখে না। 

তিনি আরো জানান, বেতন কম হওয়ায় ক্লিনিকে কর্মরত কর্মীর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ কোটি ২৫ লাখ ১০ হাজার ৪১৩ দম্পতিকে ৮ কোটি ১ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯৬টি জন্মনিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালে ১০ কোটি ৮৮ লাখ ২৭ হাজার ৩৭০ জন দম্পতির মধ্যে ৮ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার একটি জন্মনিয়ন্ত্রক দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে যা ছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৯২ হাজার ৫১৭ জনের মধ্যে ৮ কোটি ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬৭টি।

যদিও বস্তিবাসীদের মধ্যে কতটি দেয়া হয়েছে তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪ অনুযায়ী, সাত বছর ধরে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% এবং নিট প্রজনন হার ২.৩ হয়েছে। প্রজননের হার কমিয়ে ১% এ নিয়ে আসতে হবে। তবে দেশের বাকি অংশের তুলনায় ঢাকা বিভাগের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার খুবই কম। আসলে গত কয়েক বছরে এ মাত্রা কিছু শতাংশ কমছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের মতে, ঢাকার জনসংখ্যা ১৮.২ মিলিয়ন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ অষ্টম। জানুয়ারি ২০১৫-এ, ঢাকা বিভাগে গর্ভনিরোধক গ্রহণ হার ছিল, দম্পতিদের মধ্যে ৭৮%, জানুয়ারি ২০১৬ এ এটি ৭৭.৪% এবং জানুয়ারি ২০১৭ সালে ৭৭.৫৫% ছিল। সর্বোচ্চ গর্ভনিরোধক গ্রহণ হার রাজশাহী বিভাগে, যেখানে বর্তমানে ৮০.৬% দম্পতি গর্ভনিরোধক ব্যবহার করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুন্নবী বলেন, সিটি কর্পোরেশনের এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল এবং উভয় সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে গর্ভনিরোধক গ্রহণ হার আসলে সন্তোষজনক। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং বস্তিবাসীদের কাছে পৌঁছানোর সমস্যা রয়েছে।

জেএ/এসএইচএস/পিআর