ফিচার

৩৫ বছর ধরে ভাঙছে নদী

আয়েশা বেগম। বয়স পঞ্চাশের উপরে। স্বামী সৌদি প্রবাসী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। কয়েক বছর আগে নিজস্ব জমিতে বাড়ি করেছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িতে বিল্ডিং করেছেন। নতুন বাড়ির গাছগুলো বড় হচ্ছে। কোন কোন গাছ ফলও দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে চলছে তাদের জীবন। এ স্বাভাবিক এ জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে মেঘনা। বাড়ির জমি ছাড়া বাইরের জমিগুলো নদীর বুকে বিলীন হয়েছে।

Advertisement

ছেলের কাছে নদীভাঙনের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এভাবেই দিন যায়, রাত পোহায়। তবুও আশায় বুক বাঁধেন, হয়তো স্বপ্নের বাড়িতে জীবন পার করে দিতে পারবেন। কিন্তু এ স্বপ্নও মেঘনার কাছে পরাজিত হয়। সব ভেঙে নিঃস্ব করে দিয়ে যায় সর্বনাশী মেঘনা।

অন্যত্র ঠিকানা গড়ার জন্য আয়েশা বেগমের নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। ধার-দেনা, ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে দূরে বাড়ি করেন। ছোট মেয়েটিরও বিয়ে হয়ে যায়। বড় ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে। ভাঙনে থেমে যায় মেজ ছেলের পড়াশোনা। ওদিকে প্রবাসে ধুঁকছেন তাদের বাবা। সংসারের ধার-দেনা দিতে দিতে নিজের বয়স অস্ত যায়। তবুও তার প্রবাস থেকে ফেরা হয় না। কারণ নদীভাঙনের ৭-৮ বছর পার হলেও ক্ষত এখনো শুকায়নি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে মেজ ছেলেকেও প্রবাসে পাঠান। ফলে ধার-দেনা এখনো লেগে আছে সংসারে।

> আরও পড়ুন- ৪০ জেলা ঘুরে বিপন্ন মানুষের গল্প শুনেছেন ডালিম

Advertisement

নদীভাঙনের এমন করুণ গল্প লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের। যেখানে নদী ভাঙছে ৩৫ বছর ধরে। তবুও নদী ক্লান্ত হয়নি। ভাঙতে ভাঙতে নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হয়েছে উপজেলার দু’টি ইউনিয়ন। দু’টি ইউনিয়নের উদ্বাস্তু মানুষকে আশ্রয় দিয়ে জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে অন্য ইউনিয়নগুলো। কোথাও কোথাও মানুষের ভিড় হৃদয় বিদারক ঘটনাকেও হার মানায়। তবে নদীর পাড়ে নেই কোলাহল। ভাঙনে সব হারানো মানুষগুলো কেবলই চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন। এখানে এমনও মানুষ আছেন, যাদের জমি নদীভাঙনের কবলে পড়েছে ৮-৯ বার। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও মেঘনার গ্রাসে ব্যর্থ হন তারা।

উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের বর্তমান বাসিন্দা মোশারফ বাঘা। বয়সের ভারে শরীরটা তার নুয়ে পড়েছে। তবুও তাকে জীবিকার টানে ছুটতে হয়। নদীতে ৯ বার ভেঙেছে তার বসত-ভিটা। তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। জরাজীর্ণ একটি টিনের ঘরে কোনমতে টিকে আছেন।

বহু মানুষকে দেখা যায় রাস্তার পাশে। খোলা আকাশের নিচে কিংবা অন্যের বাড়িতে ঠাঁই নিয়ে অসহায় জীবন পার করছেন তারা। চর মার্টিনে ঠিকানা বদল করা আবুল কাশেমের (৪৫) বাড়ি ছিল কমলনগরের পশ্চিম চর লরেন্স হাজিগঞ্জ এলাকায়। কিন্তু নদীভাঙনে তিনি পুরোই অসহায়। সবশেষে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু ছেলে নিরবের পড়াশোনাও থেমে গেছে।

> আরও পড়ুন- উপকূলে সবুজের হাতছানি

Advertisement

এমন শত শত গল্পের নাম কমলনগর। এসব ভাঙন কবলিত মানুষের পাশে কেউ নেই। স্থানীয় মানুষের দাবি ও গণমাধ্যমকর্মীদের লেখালেখির কারণে মাত্র এক কিলোমিটার এলাকায় তীররক্ষা বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু তা-ও দশ বার নদীতে ধসে পড়েছে। এখন পর্যন্ত এলাকায় নদীর তীররক্ষা বাঁধের জন্য আশার কথা শোনা গেলেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই। যার কারণে উপজেলাটি নদীভাঙনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

উপজেলার ১৭ কিলোমিটার এলাকা মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত। পুরো ১৭ কিলোমিটারেই ভাঙনের তাণ্ডব চলছে। আর এতেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে উপজেলাটি। ভাঙন রোধের দাবিতে স্থানীয়রা ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, জেলা-উপজেলা পর্যায় এমনকি নদীর পাড়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করেছে।

মেঘনাতীরের চর ফলকনের লুধুয়া, পাটোয়ারীর হাট, চর লরেন্সের নবীগঞ্জ, সাহেবেরহাটের মাতাব্বরহাট এবং চর কালকিনির নাছিরগঞ্জ এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা এ বর্ষায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভাঙনের তথ্য সংগ্রহে গেলে এসব এলাকায় এমনই চিত্র চোখে পড়ে।

> আরও পড়ুন- গাছে গাছে ঝুলছিল মানুষের লাশ!

নদীর বাঁধ সুরক্ষার দাবিতে মাঠে থাকা একজন তরুণ মো. ফারুক। নদীতে ভিটে-বাড়ি হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নদীতে একবার বাড়ি ভেঙেছে। আবারও ভাঙনের আশঙ্কায় আছি। জানি না, কী হয়? নদী বেশি ভাঙছে নদীর মাঝে ডুবোচর জাগায়। যার কারণে পানি প্রবাহ উল্টো দিকে মোড় নেয়। আবার দেখা গেছে, জাহাজগুলো নাব্যতা সংকটে নদীর কূলঘেঁষে যায়। যে কারণে ঢেউয়ের প্রভাব পড়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নদীভাঙন রোধে ডুবোচরে ড্রেজিং করলে কমলনগর রক্ষা পাবে। না হলে আমরা অস্তিত্ব হারাবো। নদীতে কমলনগর ভাঙলে পাশের উপজেলা রামগতিও দ্বীপ হয়ে যাবে। কারণ তখন জেলা শহর থেকে রামগতি যেতে হলে নদীই হবে ভরসা। সড়কটাও ভেঙে যাবে।’

স্থানীয়দের দাবি, দ্রুতই যেন নদীতে বাঁধের জন্য জরুরি বরাদ্দ দেয় সরকার। না হলে এখানকার আড়াই লাখ মানুষের জীবন অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। কমলনগরের মানুষ চায়, দু’মুঠো ভাত খেয়ে সবার মতো জীবন পার করতে।

এসইউ/এমএস