টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলতে এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী অথবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির মূল উদ্বেগ নিরসনে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বিকেলে চীনের ডালিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সভায় ‘কো-অপারেশন ইন দ্য প্যাসিফিক রিম’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
Advertisement
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মাঝেমধ্যে শুধু কয়েকটি বৃহৎ অর্থনীতির সক্ষমতা অথবা তাদের প্রয়োজনের আঙ্গিকেই সবকিছু দেখি। কিন্তু টেকসই বিশ্বের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের অথবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতিগুলোর মূল উদ্বেগ নিরসনের উপায়ও বের করতে হবে। আমার পাঁচ দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আমাকে বলছে যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও দুর্বল অর্থনীতিকে মাথায় রেখেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। এগুলো হচ্ছে- প্রথমত : দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক শান্তি-সম্প্রীতি স্থিতিশীলতার পরিবেশ সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত: টেকসই উন্নয়নের সব দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তৃতীয়ত: দেশগুলোর পারস্পারিক স্বার্থে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত: সবা জন্য সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সার্বিক উন্নয়ন করতে হবে। পঞ্চমত: প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয় সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন ভারতের সাথে গঙ্গা নদীর পানি বন্টন করা ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ইস্যু। আমরা পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত করেছি এবং এখন বাংলাদেশ ও ভারত আন্তঃসীমান্ত নৌপথ উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সব সময় বিশ্বাস করেন যে আয়তনের দিক দিয়ে ভারতের চেয়ে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন ও যোগাযোগের মাধ্যমে এর ভূখণ্ড ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি নীতিভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। হা, ভূ-রাজনীতি সবসময়ই জীবনের একটি অংশ। তবে আমাদের সতর্কতার সাথে ইস্যুগুলোকে মূল্যায়ন করে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। আমরা স্বল্প সময়ের অর্জনের জন্য দীর্ঘদিনের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে পারি না। শেখ হাসিনা বলেন, সকল দেশের মধ্যে অভিন্ন সমৃদ্ধি নিশ্চিতে এখনো প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অঞ্চল বলে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। একইভাবে, বঙ্গোপসাগর একটি উদীয়মান ও সমৃদ্ধ অঞ্চল। এই অঞ্চলে ১.৫ বিলিয়ন লোকের বাস। তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের আশপাশে বসবাসকারী মানুষের উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটিকে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে।’
এরপর প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততা এবং বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে চীনের ঋণ প্রদান বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বৈদেশিক ঋণ মোট জিডিপি’র ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এটা শক্তিশালী অর্থনীতির একটি লক্ষণ। চীন আমাদের অবকাঠামোগত কিছু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ নদীর উপর ৬ দশমিক ৯ কিলোমিটার সেতু নির্মাণে চীনা কোম্পানি নিয়োগ করা হয়েছে।
Advertisement
এবং এর সম্পূর্ণ তহবিল জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অনেক মানুষ ‘ঋণের ফাঁদ’ নিয়ে কথা বলেন। আমার সোজা কথা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই মেগা প্রকল্পগুলোয় জনগণের স্বার্থ রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ এবং সঠিকভাবে এতদসংক্রান্ত আলোচনার অধিকার রয়েছে এবং এ নিয়ে আমাদের দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সরকারের গত ১০ বছরে আমি চেষ্টা করেছি, আমাদের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষাকে বিশ্বময় আমাদের বন্ধুদের কাছে এক ভারসাম্যময় ও লক্ষ্যভিত্তিক উপায়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য। আমি সবসময় এটা পরিষ্কার করে রেখেছি যে, বাংলাদেশ সামরিক কোন উচ্চাকাক্সক্ষার প্রশ্রয় দেয় না। এটি আমাদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিরোধী।
এর আগে আমাদের সরকারের গত টার্মে (২০১৪-১৮) আমরা সাবলিলভাবে ভারত-চীন-জাপান-যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছি।
তিনি বলেন, একটি দ্রুত বিকাশমান অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যেক বন্ধু রাষ্ট্রকেই প্রয়োজন এবং অবশ্যই কাউকে বাদ দিয়ে নয়।
আমাদের প্রতিটি বন্ধুর মাঝেই দক্ষতা ও আগ্রহ রয়েছে। আমাদের সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে হওয়ায় আমরা যা কিছু অর্জন করবো, সবটুকুই জনগণের কল্যাণে আসবে। যেমন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক শুধু মাত্র কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের প্রাণের সম্পর্ক। তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা একসঙ্গে রক্ত দিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও ভালো। আমাদের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে চীন আমাদের সঙ্গী। শুধুমাত্র ওডিএ অংশিদার ছাড়াও, জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। রাশিয়াও আমাদের সঙ্গী যারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন তারা আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা খাতে সহায়তা করছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের আরসিইপি-এ (রিজিওনাল কমপ্রেহেন্সিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ) অথবা সিপিটিপিপি (কমপ্রেহেন্সিভ এন্ড প্রগ্রেসিভ এগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) যোগদান সম্ভাব্য সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, মধ্য ৯০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম দ্রুত অর্থনীতি উদারিকরণের দেশ।
আমরা তখন এলডিসি এবং ছোট অর্থনীতি রাষ্ট্র ছিলাম। ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমরা উন্মুক্ত করতে সম্মত হয়েছি। আমরা উপলব্ধি করেছি যে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য আশপাশের দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বিশ্বের সাথে দ্রুত যোগাযোগ রক্ষাটা জরুরি।
এখন থেকে দশ বছর পর বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এর জন্য আমাদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা আমরা সংশোধন করতে প্রস্তুত। সুতরাং উন্মুক্ত আঞ্চলিকতার পক্ষে আমরা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে ভারত, জাপান, চীন এবং আরো অনেকের সঙ্গে কাজ করছে। এ কারণে আমরা লক্ষ্যভিত্তিকভাবে বিসিআইএম-ইসি এর পাশাপাশি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথে এগোচ্ছি।
মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটির জন্য কিছু দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক এফটিএ’র লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের আয়তন-অবস্থান-প্রকৃতি-কাঠামোগতভাবে বাংলাদেশ আরসিইপি এ যোগ দিতে প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন, আমরা আশিয়ানের অংশিদারিত্বের জন্যও যোগাযোগ করছি। সূত্র : বাসস।
এনএফ/জেআইএম