দেশজুড়ে

বিনা চিকিৎসায় পড়ে আছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য

যশোরের সন্তান লুৎফর রহমান। মুক্তিযুদ্ধকালীন ফুটবল দলের ৩৬ জন নিয়ে গড়া টিমের অন্যতম একজন ফুটবলার। যাদের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশ স্বাধীনের আগেই বিদেশের মাটিতে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান প্রায় ৬ মাস ধরে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেও দেখার কেউ নেই।

Advertisement

যে মানুষটি স্বাধীন দেশ ও পতাকার জন্য লড়েছেন, সেই স্বাধীন দেশেই জীবন সায়াহ্নে এসে আজ তিনি কপর্দকহীন। কিন্তু তার এই অসহায় অবস্থায় পাশে এসে দাঁড়ায়নি কোনো ক্রীড়া সংগঠক ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে এই মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত হচ্ছেন সুচিকিৎসা থেকে।

যশোর লোন অফিসপাড়ার বাসভবনে গিয়ে লুৎফর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণকারী লুৎফর রহমান ছোটবেলা থেকেই ফুটবল এবং হকি খেলায় আগ্রহী ছিলেন। যশোর জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ফুটবল খেলায় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান। তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত যশোর জেলা ফুটবল দলের হয়ে নিয়মিত খেলায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ড দলের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মিলিত বোর্ডের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা ওয়ারী ক্লাবে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

এরই মধ্যে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তখন দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত সৃষ্টিতে খেলোয়াড়দের ডাক দিয়ে সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেন কয়েকজন তরুণ আলী ইমাম, প্রতাপ, প্যাটেল, জাকারিয়া পিন্টু, আশরাফ ও মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান।

Advertisement

লুৎফর রহমান বলেন, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে ভারতীয় মুদ্রার ৩ লাখ টাকা তুলে তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কাছে দিয়েছিলাম।

১৬টি খেলার মধ্যে ১২টি খেলায় জয়লাভের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সব থেকে গৌরবময় খেলাটি ছিল ২৪ জুলাই ভারতের নদীয়া স্টেডিয়ামে। ওই দিন ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম খেলা। খেলোয়াড়রা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে তারা মাঠ যাবে। এরপর মাঠে আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উত্তোলন করতে হবে। বিষয়টি নদীয়া ক্রীড়া সমিতিকে যথাসময়ে অবহিত করা হয়। এই খেলাকে কেন্দ্র করে নদীয়া স্টেডিয়ামে ব্যাপক ফুটবলপ্রেমী জড়ো হয়েছিল।

অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার মারফত খেলার বিষয়ে অবহিত হয়ে কুষ্টিয়া জেলা থেকে উৎসাহী ক্রীয়ামোদীরা বিপুল সংখ্যায় মাঠে সমবেত হন। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন নিয়ে। ভারতের সরকার তখন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। খেলার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু পতাকা ও জাতীয় সংগীতের বিষয়ে নিষ্পত্তি ছাড়া বাংলাদেশের ফুটবল দল মাঠে নামবে না কিছুতেই। অবশেষে নদীয়ার জেলা প্রশাসক স্বপ্রণোদিত হয়ে ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানোর বিষয়ে সম্মত হয়। সেদিন পিন্টু-প্রতাপের হাতে ধরা মানচিত্রখচিত পতাকা উড়লো বিদেশের মাটিতে।

এই খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথমবারের মত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে অন্য একটি স্বাধীন দেশের পতাকার সমমর্যাদায় উত্তোলিত হয়। এ ঘটনার পর নদীয়ার জেলা প্রশাসক সাময়িক বরখাস্ত হন এবং নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাফিলিয়েশন বাতিল করা হয়। কিন্তু এ সংস্থার নজিরবিহীন ঘটনা রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুলভাবে উৎসাহিত করে।

Advertisement

এ ব্যাপারে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় কাওছার আলী বলেন, গত ২০ জুন লুৎফর ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে অত্যন্ত বেদনার্ত, মর্মাহত এবং লজ্জিত হলাম। দেখলাম জাতি তথা আমাদের যশোরের গর্ব ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ এবং জাতীয় ফুটবল খেলোয়াড় লুৎফর ভাই ছয় মাস ধরে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য! এই বেদনার খবর তার পরিবার ছাড়া যশোর তথা দেশের কেউ রাখি না।

যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব কবির বলেন, লুৎফর দেশ তথা আমাদের যশোরের গর্বিত সন্তান। তার এই সময়ে সকলকে তার পাশে থাকা দরকার। আমি সরকারে কাছে আবেদন করি, যাতে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

মিলন রহমান/আরএআর/আরআইপি