নারী ও শিশু

পরিবার পরিকল্পনায় বরাদ্দ বাড়ছে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই

উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতেরও। উন্নয়নের পেছনে ভূমিকা রেখেছে এমন কয়েকটি খাতের উল্লেখযোগ্য একটি হলো পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। বর্তমান সরকার পরিবার পরিকল্পনা খাতে বেশ জোর দিচ্ছে। এজন্য প্রতি বছরই বাজেটে এ খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়। যদিও এ কার্যক্রম বর্তমানে কিছুটা স্থবির হয়ে আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। নতুন অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আগের তুলনায় বরাদ্দ বেশি বলে সরকারের মহল থেকে দাবি করলেও এ বরাদ্দ অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য খাতের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালন ব্যয় ১০ হাজার ৭ কোটি ও উন্নয়ন ব্যয় ৯ হাজার ৯৩৬ কোটি এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি এবং উন্নয়ন ব্যয় ধারা হয়েছে ২ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১.০২ শতাংশ এবং মোট বাজেট বরাদ্দের ৫.৬৩ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান ২০১৮-১৯ অর্থবছরের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ছিল ২২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’ শীর্ষক এ বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।

সরকারি তথ্য মতে, সঠিক পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা গেলে অনেক মাতৃ মৃত্যু কমে আসবে। বর্তমানে মাতৃ মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭২ জনে নেমে এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বলেছেন, সরকার পরিবার পরিকল্পনা খাতে আগের চেয়ে বেশি নজর দিচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়ন মানে সবার উন্নয়ন। এ জন্য সরকার পরিবার পরিকল্পনা খাতে বেশি জোর দিয়েছে। এ খাতে বরাদ্দও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম আরও জোরদার করতে গণসচেতনতা কার্যক্রম আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে সুস্থ-সবল সন্তান জন্মদানে নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

Advertisement

জানা গেছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদে এক লাখ ১৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় স্বাস্থ্য খাতে চতুর্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (৪র্থ এইচপিএনএসপি) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যার আওতায় মোট ২৯টি অপারেশনাল প্লানের মাধ্যমে সারাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান ও চিকিৎসা শিক্ষার মানোন্নয়ন করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচির ৮৪ শতাংশই সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে। এদিকে বৈশ্বিক পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক প্রতিশ্রুতি এফপি ২০২০-তে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকার করেছে ২০২১ সালের মধ্যে উন্নয়ন বাজেট থেকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে ৬১৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার এর বরাদ্দ করবে।

পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ জনগোষ্ঠীর বিষয়ে নতুন কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। তবে এ বিষয়ে আরো অধিক অর্থ বরাদ্দ ও তরুণদের কার্যকরী অংশগ্রহণ জরুরি বলে জানান সিরাক-বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত।

তবে পরিবার পরিকল্পনা সমিতির (এফপিএবি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত কয়েক বছর পরিবার পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এ কথা সত্যি যে, প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়ছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। এ খাতে বরাদ্দ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি মাঠপর্যায়ে লোকবলও বাড়াতে হবে বলে জানান তিনি।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশ এর স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ড. সাথিয়া দোরাইস্বামী জানান, ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ও এফপি ২০২০ এর উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাকে বেগবান করতে ২০১৫ সালে কস্টেড ইমপ্লিমেন্টেশান প্ল্যান (সিআইপি) গ্রহণ করা হয়। সিআইপি পলিসি ব্রিফিং ফর এফপি২০২০ সূত্র মতে, ২০১৬ থেকে ২০২০, এই ৫ বছরের মধ্যে এফপি২০২০ লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন, তার মোট পরিমাণ ১৩৭৭.৩৬ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস ও সেবা খাতের জন্য প্রয়োজন যথাক্রমে ৩৩৭.৫৯ ও ৯২০.৭৫ মিলিয়ন ডলার।

Advertisement

ড. সাথিয়া দোরাইস্বামী বলেন, চতুর্থ জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যখাতের প্রয়োজনীয় উপকরণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র ১৯৭.৮৩ মিলিয়ন ডলার। ৫ বছরের জন্য স্বাস্থ্যখাতের প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয়ের জন্য এই বরাদ্দে পরবর্তীতে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

সুতরাং, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয়ে ৫ বছরের জন্য যে এককালীন বরাদ্দ দেওয়া হয় তার পরিমাণ বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি বিষয়।

মেরী স্টোপস বাংলাদেশ-এর অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার মঞ্জুন নাহার বলেন, পরিবার পরিকল্পনায় বরাদ্দ বাড়ানো অবশ্যই সরকারের একটি আশাব্যাঞ্জক পদক্ষেপ। তবে পাশাপাশি কার্যকরীভাবে বাজেট ব্যয়ের বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। কেননা পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমেই মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

জানা গেছে, বর্তমানে ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ সেবাপ্রার্থী একেকটি ক্লিনিক থেকে সেবা নিয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। সারাদেশে প্রায় ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব সেবা দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পদযাত্রায় পা রাখলো। বাস্তব সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক। অর্থসংকুলান সবকিছুর চালিকাশক্তি। সেক্ষেত্রে রাতারাতি বাংলাদেশের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এরপরেও বাংলাদেশ গর্ব করার মতো যে বিষয়গুলো বিশ্বে সমাদৃত অর্জন রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর বিশাল আকারের বাজেট ঘোষণা করা হলেও সরাসরি জনগণের সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত এ খাতে আশানুরূপ বরাদ্দ বাড়ছে না। বরাদ্দ বাড়লেও তা অনুন্নয়ন খাতেই খরচ হচ্ছে। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে বাজেটের অর্থ ব্যয়, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, মনিটরিং, জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে সাধারণ মানুষ সুবিধা পাবে।

তবে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বয়স কাঠামোয় আশাব্যাঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। কারণ জনসংখ্যার পরিমাণগত ও কাঠামোগত মানদণ্ডে বাংলাদেশ এমন একটি সময় পার করছে, যেখানে নির্ভরশীলতার হার সবচেয়ে কম এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদি-সংক্রান্ত পপুলেশন ডিভিশনের প্রক্ষেপণ তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৫ সালে যেখানে ১৫-৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছিল ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ, তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৫ সালে হয় ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন নির্ভর করে তার সুযোগ সৃষ্টি, সুযোগের সদ্ব্যবহার ও তা দীর্ঘায়ন করার ওপর। এ লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল প্রয়োজন। এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে হবে আমাদের, যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০৪০ সালে পৌঁছাবে ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা ক্রমেই কমবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, আইইএম ইউনিটের পরিচালক, লাইন ডাইরেক্টর আইইসি আশরাফুন্নেসা বলেন, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় পরিবার পরিকল্পনাকে দেখতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ ও কর্মসূচি হিসেবে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটি বেশ স্পষ্ট যে, পরিবার পরিকল্পনা জীবন রক্ষা করে এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটায়। ফলে পরিবার পরিকল্পনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের ব্যক্তি ও দেশের কল্যাণে; সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে।

জেএ/এসএইচএস/এমএস