অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ফলে তারল্য সংকট রয়েছে অনেক ব্যাংকে। ধারাবাহিকভাবে কমছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। আমানত ও ঋণের সুদহারেও নেই শৃঙ্খলা, অস্থির ডলারের বাজারও। ফলে নানামুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। যার প্রভাব পড়েছে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের (জানুয়ারি-জুন) পরিচালন মুনাফায়।
Advertisement
জানা গেছে, দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রান্তিক (তিন মাস) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দেয়।
আরও পড়ুন >> খেলাপি গিলে খাচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা
এর আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। এরপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেই তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না।
Advertisement
তবে বিভিন্ন সূত্রে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেড়েছে। তবে তা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
তাদের অভিমত, এবার ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় অংশই এসেছে কমিশন, সার্ভিস চার্জ, আমদানি-রফতানি আয় থেকে। ব্যাংকের আয়ের প্রধান খাত সুদ হলেও এবার এ খাত থেকে আদায় হয়েছে খুবই কম। এর প্রধান কারণ আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য (স্প্রেড) কম ছিল। যে কারণে মুনাফার অঙ্ক প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। এছাড়া তারল্য সঙ্কটে এ বছর ঋণ বিতরণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায় হয়নি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মুনাফায়।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ পরিচালন মুনাফা থেকে ব্যাংকের ঋণ ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লোকসান দেয়ায় এর বিপরীতে প্রভিশনের পরিমাণ আরও বাড়বে। ফলে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফাও কমবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আনিস এ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগের বছরের তুলনায় এবার পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এর মূল কারণ সার্ভিক ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো ছিল। তবে স্প্রেড কম থাকায় সুদ থেকে আয় কমেছে। যে কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিচালন মুনাফা হয়নি।
Advertisement
আরও পড়ুন >> অধিকাংশ ব্যাংকের বেড়েছে পরিচালন মুনাফা
পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে, ২০১৯ সালের জুন মাস শেষে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে এক হাজার ২২৩ কোটি টাকা, যা আগের বছর একই সময় ছিল এক হাজার ২০ কোটি টাকা; সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২৯৫ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ২৭৫ কোটি টাকা; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৮১ কোটি টাকা, আগে ছিল ১২৮ কোটি টাকা; আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ৪০৫ কোটি টাকা, আগে ছিল ২৬০ কোটি টাকা; শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৩২০ কোটি, আগে ছিল ২১৫ কোটি টাকা।
এছাড়া এক্সিম ব্যাংকের ৩৩০ কোটি টাকা, আগে ছিল ৩২৫ কোটি; প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২৬৪ কোটি টাকা, গত বছর ছিল ২১০ কোটি; সাউথ ইস্ট ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৫০৫ কোটি টাকা, আগে ছিল ৪৫৬ কোটি; তবে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে। ব্যাংকটির জুন শেষে মুনাফা হয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা, আগের বছর একই সময় ছিল ৪৫৭ কোটি। ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের মুনাফা ৫১০ কোটি টাকা, আগে ছিল ৪১৮ কোটি; মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৩৩১ কোটি টাকা, গত বছর ছিল ৩২৫ কোটি; ঢাকা ব্যাংকের ৩০০ কোটি, আগের বছর ছিল ২৬০ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৭৩ কোটি টাকা, গত বছর ছিল ২২৯ কোটি। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে। ব্যাংকটির জুন শেষে মুনাফা হয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৩৩৭ কোটি; এনসিসি ব্যাংকের ৩৬২ কোটি টাকা, আগে ছিল ২৯৭ কোটি; ব্যাংক এশিয়ার ৪৬৫ কোটি টাকা, গত বছর ছিল ৪১৭ কোটি; আইএফআইসি ব্যাংকের ২৯৭ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ১৫৫ কোটি; চতুর্থ প্রজন্মের মিডল্যান্ড ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৩৭ কোটি; যমুনা ব্যাংকের ৩১১ কোটি, আগে ছিল ২৬৭ কোটি টাকা।
এনআরবিসি মুনাফা করেছে ৯০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৭৭ কোটি; সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ৯০ কোটি টাকা; আগে ছিল ৮৮ কোটি; মেঘনা ব্যাংকের ৪৫ কোটি টাকা, গত বছর একই সময়ে ছিল ৩৫ কোটি; মধুমতি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৯৮ কোটি, গত বছর একই সময়ে ছিল ৯০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, যেকোনো ব্যবসার প্রবৃদ্ধি খুবই স্বাভাবিক। ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফাতেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে মুনাফা খুব সাংঘাতিক বেড়ে যাবে, তা নয়। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা প্রকৃত মুনাফা নয়। বছর শেষে পরিচালন মুনাফা থেকে কর, প্রভিশনসহ অনেক কিছু বাদ দিয়ে নিট বা প্রকৃত মুনাফা হিসাব করা হয়ে থাকে। ফলে মুনাফা খুব বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ব্যাংক খাতের এ খেলাপি ঋণের বিপরীতে বিশাল অংকের নিরাপত্তা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণ না থাকলে মুনাফা আরও ভালো হতো বলে ব্যাংকাররা মনে করেন। এজন্য খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> বাজেটে কী পেল জনগণ?
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আতাউর রহমান প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার মুনাফা কিছুটা কম হয়েছে। এর মূল কারণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে, অন্যদিকে সুদহার কমানো হয়েছে। তবে এবার ব্যাংকের সার্বিক কমপ্লাইন্সের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় বাড়ানোর টার্গেট নেয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে আগামীতে মুনাফা আরও বাড়বে।’
জানা গেছে, পরিচালন মুনাফা থেকে ব্যাংকগুলোকে আগে নিয়মিত ঋণ ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ১ থেকে ২ শতাংশ, খেলাপির মধ্যে নিম্নমান ঋণে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এরপর মূলধন বাড়াতে তহবিলের একটা অংশ নিতে হয় রিজার্ভ তহবিলে। পরিশোধ করতে হয় ৪০ শতাংশ আয়কর। অবশিষ্ট যা থাকে তা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া হয়।
ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীকে অপেক্ষা করতে হবে নিট বা প্রকৃত মুনাফার হিসাব পাওয়া পর্যন্ত। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিট মুনাফা হলেও তার সম্পূর্ণ অর্থ লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করা হয় না।
এসআই/এমআরএম/এমএআর