বাংলাদেশে দেখানো হয় এমন বিদেশি চ্যানেল ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বন্ধের কোনো প্রযুক্তি ক্যাবল অপারেটর এবং ডিস্ট্রিবিউটরদের নেই। যদিও সরকার বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে।
Advertisement
ডিস্ট্রিবিউটররা (ব্রডকাস্টারের স্থানীয় পরিবেশক) জানিয়েছেন, আইনানুযায়ী সেবা প্রদানকারী হিসেবে ক্যাবল অপারেটরদের চ্যানেল ফিল্টারিং (অযাচিত কোনো কিছু সম্প্রচারের অংশ থেকে বাদ দেয়া) করে সম্প্রচার করার কথা। ক্যাবল অপারেটররা জানিয়েছেন, চ্যানেল ফিল্টারিং প্রযুক্তি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অপারেটরদের সেই সক্ষমতা নেই। বিজ্ঞাপন মুছে দেয়া কিংবা বন্ধের কাজটি ডিস্ট্রিবিউটরদেরই করতে হবে।
অপারেটরদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত থাকলে তারা আন্দোলনে যাবেন, এমনকি আইনের আশ্রয় নেবেন বলেও জানান ক্যাবল অপারেটর নেতারা।
আরও পড়ুন>> বিদেশি টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন : জেল-জরিমানা
Advertisement
সোমবার তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশে যেসব বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল দেখানো হয়, আইন অনুযায়ী সেগুলো যাতে বিজ্ঞাপন প্রচার না করতে পারে সেজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে সরকার।
এছাড়া ক্যাবল আপারেটররা যাতে বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচার করতে না পারে এবং টেলিভিশনের মালিকদের সংগঠনের নির্ধারণ করে দেয়া ক্রম অনুযায়ী যেন টিভি চ্যানেল দেখানো হয়, তা নিশ্চিত করতেও ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করবে বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী।
ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন- ২০০৬ এর উপধারা-১৯ এ সেবা প্রদানকারী ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যেসব অনুষ্ঠান সম্প্রচার বা সঞ্চালন করা যাবে না তা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারার ১৩ উপধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।
সেবাপ্রদানকারীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এমএসডিএস, ডিটিএইচ বা অন্য কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে চ্যানেল সঞ্চালন বা সম্প্রচার করে এমন কোনো এমএসও, ক্যাবল অপারেটর, ফিড অপারেটর বা ব্যক্তি।
Advertisement
আরও পড়ুন >> ক্রমানুসারে চ্যানেল প্রদর্শন না করায় দুই ক্যাবল অপারেটরকে জরিমানা
বাংলাদেশে পে-চ্যানেলের পরিবেশক জাদু ভিশন লিমিটেডের পরিচালক নাভিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আছি ডিস্ট্রিবিউশন পার্টে। এখানে এ বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ কোনো অ্যাড যদি রিমুভ বা বন্ধ করতে হয় আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে সেটা সেবা প্রদানকারীকে করতে হবে। ডিস্ট্রিবিউটর তো সেবা প্রদানকারী নয়। সেবা প্রদানকারী হচ্ছে ক্যাবল অপারেটর বা যারা ডিটিএইচ সেবা দিচ্ছে। ডিস্ট্রিবিউটর সাবসক্রাইবার কোনো সেবা দেয় না, ডিস্ট্রিবিউটর ট্রেডিং হাউজ বা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পর্যায়ে ফিল্টারিং করার মতো কোনো প্রযুক্তি নেই। ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে আমি কোনো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি না। আমি জানি চ্যানেলটা ক্যাবল অপারেটর দেখাতে পারে, সেজন্য যে টাকা ক্যাবল অপারেটর দেয়, ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টারের কাছে পৌঁছে দেই। চ্যানেলটা যখন অন করে দেয় তখন ক্যাবল অপারেটর সেটা দেখায়। আমরা মিডলম্যানের কাজ করি, আমি শুধু চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও ক্যাবল অপারেটরদের সম্পর্ক মেইনটেইন করি।’
‘আমার জানা মতে চ্যানেলের প্রোগ্রাম থেকে বিজ্ঞাপন রিমুভ করার মতো প্রযুক্তি ক্যাবল অপরেটরদের কাছে আসেনি। আশা করি তারা ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি বসাবে।’
একজন ক্যাবল অপারেটর জানান, চ্যানেল ফিল্টারিং করার মেশিন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রতিটি চ্যানেল ফিল্টারিংয়ের জন্য ২৫ হাজার ডলার বা ২০ লাখ টাকার মতো লাগে। বাংলাদেশে ৬০টি ইন্টারন্যাশনাল পে চ্যানেল আছে। প্রত্যেকটি চ্যানেলের জন্য আলাদাভাবে ইকুয়েপমেন্ট বসাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের এই সেক্টরকে আমরা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করছি। সেইসব দেশের পুরোপুরি ট্রান্সমিশন হয় ডিজিটাল প্রযুক্তিতে। আমাদের এখনও অ্যানালগ প্রযুক্তিতে রয়ে গেছে। সেইসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করা হচ্ছে। সরকার যা চাচ্ছে তা অ্যানালগ প্রযুক্তিতে সম্ভব নয়।’
ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)- এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যাবল অপারেটরদের তো বিজ্ঞাপন কাটা বা মুছে দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। এটা ব্রডকাস্টার করতে পারেন। যদি দেখেন তবে মন্ত্রণালয় ও ডিস্ট্রিবিউটর এটা দেখবেন, আমাদের কিছু করণীয় নাই। আমি পারি চ্যানেল বন্ধ করে দিতে। ডাউনলিংক করে যেটা পাই আমি সেটাই প্রচার করি।’
‘ভ্রাম্যমাণ আদালত আসলে আমরা আমাদের বিষয়টা তুলে ধরব, এরপরও যদি শাস্তি দেয়া হয়, আমরা বসব, কথা বলব। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’- বলেন আনোয়ার।
আরও পড়ুন >> বিদেশি টিভি চ্যানেল : আইন মেনে ব্যবসা করতে হবে
কোয়াবের সদস্য সৈয়দ হাবিব আলী বলেন, ‘আমরা ডাউনলিংক করে চ্যানেল ট্রান্সমিশন করি, বিজ্ঞাপন বন্ধের কোনো ক্ষমতা আমাদের নাই। সরকারই নিয়ম ভেঙে কথা বলছে, ওনারা যখন বিদেশি চ্যানেলের লাইসেন্স দেন, এর আগে ডাউনলিংক পারমিশনের জন্য ৬ থেকে ৮ মাস চ্যানেলটা চলে। তারা যখন দেখেন এখানে খারাপ কিছু নাই তখন অনুমোদন দেন। যারা ডিস্ট্রিবিউশনের লাইসেন্স নেন তাদের ব্রডকাস্টারের সঙ্গে চুক্তি হয়। কোথাও বলা নেই বিজ্ঞাপন ছাড়া চ্যানেল চলবে। সরকার যখন অনুমোদন দেয় তখনই তো বলার কথা, বিজ্ঞাপন ছাড়া চ্যানেল প্রচার করতে হবে। অনুমোদনের পর এখন কেন বিজ্ঞাপন বন্ধ চাইছেন?’
তিনি বলেন, ‘চ্যানেল ফিল্টারিংয়ের জন্য প্রত্যেকটি চ্যানেলের জন্য আলাদা মেশিন লাগবে, লোক লাগবে। যে ক্লিন ফিডের কথা বলা হয়, সেটা খুবই ব্যয়বহুল। পে চ্যানেলের বিজ্ঞাপন বন্ধের কথা বলছে সরকার, ফ্রি-টু-এয়ার চ্যানেলের বিজ্ঞাপন বন্ধ কীভাবে করবে সরকার? তবে তো সব চ্যানেল বন্ধ করে দিতে হবে।’
হাবিব আলী আরও বলেন, ‘বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করলে গ্রাহকরা থাকবে না, আমরা না থাকলে দেশি চ্যানেলও থাকবে না। আল্টিমেটলি এ খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেটা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ক্যাবল টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (সিনওয়া) সভাপতি মীর হোসাইন আখতার বলেন, ‘সরকার এটা ডিস্ট্রিবিউটরদের বলুক। এটা ডিস্ট্রিবিউটরদের দায়িত্ব। তারা আমাদের সেভাবে দিক, আমরা সেভাবেই সম্প্রচার করব। আমাদের শাস্তি দিয়েও তো লাভ নাই। মাথা রেখে লেজ ধরে টানাটানি করে তো লাভ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এ সিদ্ধান্তে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বসব। আন্দোলনে যাব, প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেব।’
বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলে কী পদ্ধতিতে এবং কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে- জানতে চাইলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) মো. নুরুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন দেখে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বলেছি।’
ক্যাবল অপারেটররা বলেছেন, ফিল্টারিং করার মতো প্রযুক্তি তাদের নেই- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘ক্যাবল অপারেটররা তো স্থানীয়ভাবে চ্যানেল খুলে বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করা হবে না। আইন অনুযায়ী সেবা প্রদানকারী বলতে ক্যাবল অপারেটরদেরও বোঝাবে।’
আরএমএম/এসএইচএস/এমএআর/এমআরএম