খেলাধুলা

ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নয়, দলের জয় নিশ্চিত করতে চান মাশরাফি

ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের যা কিছু প্রথম, তার সবগুলোর সঙ্গেই আছেন মাশরাফি। একদিনের ক্রিকেটে ভারতীয়দের বিপক্ষে টাইগারদের প্রথম জয়ের নায়কও ম্যাচসেরা নড়াইল এক্সপ্রেস। আবার বিশ্বকাপে ভারতকে প্রথমবার হারানোর মিশনেও মাশরাফিই ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়, জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

Advertisement

ভারতের সাথে ওয়ানডে আর বিশ্বকাপে দেশের প্রথম দুটি ঐতিহাসিক সাফল্যের রূপকার ও ম্যাচ জয়ের নায়ক মাশরাফির, মঙ্গলবার সেই ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ। কি ভাবছেন মাশরাফি? সব সময় দলগত প্রচেষ্টা, দলগত পারফরম্যান্স আর সামষ্টিত অর্জন-প্রাপ্তি যার সন্তুষ্টি, সেই মাশরাফি এমন এক ব্যক্তিগত সাফল্যের ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে কি একটু হলেও আবেগপ্রবণ নন?

কালকের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে কি একটু স্মৃতিকাতর বাংলাদেশ অধিনায়ক? প্রিয় ক্রিকেটার, বোলার ও অধিনায়ককে শুরুর মতো ভারতের সাথে শেষ ম্যাচেও হিরো দেখতে মাশরাফি ভক্ত, সমর্থক ও অনুরাগীরা উন্মুখ হয়ে আছেন। তারা অমন আশা করতেই পারেন।

কারণ ইতিহাস বলে, ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে জয় আর বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের নায়ক মাশরাফি। তার বিধ্বংসী বোলিংয়ের (৪/৩৮) মুখে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে শচিন, শেবাগ, দ্রাবিড়, সৌরভ, যুবরাজ আর জহির খানের সাজানো ভারত অলআউট হয়ে গিয়েছিল মাত্র ১৯১ রানে।

Advertisement

সেটাই ছিল জয়ের ভীত। পরে তিন সম্ভাবনাময় তরুণ তামিম, মুশফিক আর সাকিবের হাফসেঞ্চুরিতে ৫ উইকেটে জয়ের বন্দরে পৌঁছলেও ভারতীয় শক্তিশালী ও বিশ্বসেরা ব্যাটিংকে দুশ’র নিচে বেঁধে ফেলার কাজটি করে ম্যাচসেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন মাশরাফি।

তারও তিন বছর আগে ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবসের ঊষালগ্নে প্রথম ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। রাজধানী ও ক্রীড়াকেন্দ্র ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ জিতেছিল ১৫ রানে।

হাবিবুল বাশার সুমনের ক্যাপ্টেন্সিতে সৌরভ গাঙ্গুলির অধিনায়কত্বে ভিরেন্দর শেবাগ, যুবরাজ সিং, মোহাম্মদ কাইফ, নয়ন মোঙ্গিয়া আর মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের রূপকার ও নায়ক মাশরাফি। ওই ম্যাচে শুধু বোলার মাশরাফির আগুন ঝরানো বোলিংয়ের কাছেই হার মানেনি ভারত। সে জয়ের দিনে মাশরাফি ছিলেন রীতিমতো অলরাউন্ডার। তার একার ব্যাটিং ও বোলিংয়ে চৌকষ নৈপুণ্যের কাছেই হেরে গিয়েছিল সৌরভ গাঙুলির দল।

প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ করেছিল ২২৯ রান। যাতে মাশরাফির অবদান ছিল ৩৯ বলে ৩১। ৯ নম্বর পজিশনে নামা মাশরাফির ওই ইনিংসটির ওপর ভর করে ২০০’তে পা রাখে বাংলাদেশ। তারপর বল হাতে ৯ ওভারে ২ মেডেনসহ ড্যাশিং ওপেনার ভিরেন্দর সেবাগ ও মহেন্দ্র সিং ধোনির উইকেট নিয়ে ভারতকে ২১৪ রানে বেঁধে ফেলার মিশনেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মাশরাফি। তারই পুরস্কার হিসেবে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা নড়াইলের সেদিনের ২১ বছর বয়সী উচ্ছল তরুণ কৌশিকের হাতেই ওঠে।

Advertisement

সেই ভারতের বিপক্ষে কাল বিশ্বকাপের এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে জিততেই হবে। জয় ছাড়া পথ নেই টাইগারদের। পুরো দেশ তাকিয়ে এখন বার্মিংহামের এজবাস্টনের দিকে। এবার বিরাট কোহলি বাহিনীর সঙ্গে কী করবে মাশরাফির দল?

দুই দলের শক্তি-সামর্থ্য আর সম্ভাবনা নিয়ে কত কথাই না হচ্ছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞরা নানারকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন। কার সম্ভাবনা কতটা? তা নিয়েও আলোচনা, পর্যালোচনা হচ্ছে। সবাই মানছেন, বলছেনও ভারত অবশ্যই শক্তিতে এগিয়ে।

ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত সামর্থ্য, মেধা, যোগ্যতা, অর্জন, কৃতিত্ব ও পারফরম্যান্সের আলোকে ব্যাখ্যা করলেও ভারত এগিয়ে। তাদের রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলি সবচেয়ে বড় পার্থক্য। যারা এ মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটেরও অন্যতম দুই সেরা ও সফল টপ অর্ডার। যাদের সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে কোনো কথা বলারই দরকার নেই। সঙ্গে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মোহাম্মদ সামি, জাসপ্রিত বুমরার পেস জুটি। যাদের পাশে চাহাল, কেদার যাদভ, কুলদীপ যাদভ, রবীন্দ্র জাদেজার ধারালো বোলিং।

এমন শক্তিকে হারানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু না হারালেও চলবে না। কারণ নিজেরা হারলেই বিদায়। এমন এক কঠিন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে মাশরাফি আসলে কি ভাবছেন? দল জেতানোর পাশাপাশি নিজের কথা কি একটুও মনে হচ্ছে না?

একবার কি ভাবছেন না ইস! যদি বিশ্বকাপে ভারতের সাথে শেষ ম্যাচেও নায়ক হতে পারি? কে না চায়? মাশরাফির জায়গায় অন্য যে কেউ হলে হয়তো তাই চাইতেন। বলতেন হ্যাঁ, ভারতের সাথে আমার ব্যক্তিগত অর্জন আছে দুটি। চেষ্টা থাকবে বিশ্বকাপে শেষ বার ভারতের বিপক্ষে ম্যাচকে স্মরণীয় সাফল্যে গেঁথে রাখতে।

এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তে মাশরাফি ঠিক এমন প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিলেন। তাই তো প্রেস কনফারেন্স শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হলো ভর্তি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনেও খানিক আবেগতাড়িত মাশরাফি ওই প্রশ্নকর্তাকে বলে গেলেন, আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর দ্যাট কোশ্চেন ফ্রম ইউ।

কণ্ঠে একটু আবেগ থাকলেও কথা ও ব্যাখ্যায় কোনো আবেগ টাবেগ নেই। একদম অন্যরকম এক অনুভূতি। উত্তর দিতে গিয়ে মাশরাফি বলে উঠলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি আপনি ২০০৪ সালের প্রথম জয় আর ২০০৭ সালের প্রথম বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোর ম্যাচের কথ বলছেন। হ্যাঁ সেটা অবশ্যই সুখস্মৃতি। তা আমাকে আনন্দ দেয়। ভালো লাগে। ওই দুই ম্যাচের কথা মনে হয় আমারও। তবে কালকের ম্যাচের আগে আমি নিজের ব্যক্তিগত মাইলফলক বা সাফল্যের কথা ভাবতে চাই না। ভাবার কথাও না।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি ফিরে যেতে চাই ২০০৪ আর ২০০৭ সালে। আমরা যে দুবার ভারতকে হারিয়েছিলাম, তখন অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন ভাই। তিনি আমাকে একা নিয়ে নন, পাঁচ-ছয়জনকে নিয়ে গেমপ্ল্যান করেছিলেন। আমার ওপর একটা দায়িত্ব-কর্তব্য ছিল। সৌভাগ্যবশত, আমি দুবারই সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য ভালোমতো করতে পেরে সফল হয়েছিলাম।’

‘আমরা জিতেও ছিলাম। এখন কালকের ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবে আমি তাই চাই। আমি ভারতের বিপক্ষে আগে দুবারের ঐতিহাসিক সাফল্যের দিনে ম্যাচসেরা, তাই কালকের অনেক হিসাব-নিকেশের ম্যাচেও আমাকেই জয়ের নায়ক হতে হবে, এমন ভাবতে চাই না। আমি চাই আমার দল জিতুক। আমরা সফল হই। দল জিতলে যে কেউ ম্যাচ জয়ের নায়ক হলেই আমি খুশি। তবে এখন সে যেমন ফর্মের চূড়ায় আছে, তাতে সাকিবই হতে পারে আমাদের জয়ের নায়ক। সাকিব যদি কাল জয়ের নায়ক হয়, সেটাই হবে অনেক বেশি ভালোলাগার ও আনন্দের।’

সমালোচক আর নিন্দুকরা হয়তো ভাবছেন, নিজের ফর্ম ভালো নেই তো, তাই মাশরাফির আত্মবিশ্বাস ও আস্থা কম। সে কারণেই অন্যের কাঁধে ভর করে দল জেতানোর কথা ভাবছেন। আসলে মোটেই তা নয়। অধিনায়ক হিসেবে আসলে যা ভাবা উচিত আর যা বলা দরকার, মাশরাফি ঠিক তাই বলেছেন।

তিনি এখন আর শুধু পারফরমার, বোলার ও লেট অর্ডার ব্যাটসম্যান নন। দলের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে দলের জয়টাই আসল। এখন তিনি কার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে, কি গেমপ্ল্যান এঁটে ভারত বধ মিশনে সফল হবেন? সেটাই আসল। তিনি কত ভালো খেললেন, কী অবদান রাখলেন, ব্যক্তিগত অর্জন আর প্রাপ্তির ভান্ডারে কী জমা পড়লো- তারচেয়ে দল জেতাটাই কি বড় নয়?

ধরা যাক, মাশরাফি ১০ ওভারে ৪০-৪৫ রান দিয়ে ৪ উইকেট পেলেন, পরে নিচের দিকে ২০-২৫ রান করলেন। কিন্তু দল জিতলো না, তাহলে কী হবে? কেউ কি তা মনে রাখবে? তাই মাশরাফি চাচ্ছেন স্মরণীয় সাফল্য তথা জয়। আর সে জয়ে নায়ক ও রূপকার-স্থপতি যেই হোন না কেন, অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে সে জয় ধরা দিয়েছে, সেটাই কি অনেক বড় নয়?

এআরবি/এসএএস/জেআইএম