দেশজুড়ে

কৃত্রিম প্রজননে ভেটকির পোনা উৎপাদনে সাফল্য

প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ভেটকি বা কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। সেইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার-সোনাদিয়া উপকূলজুড়ে ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সুস্বাদু কোরাল ও তাইল্যা মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তারা। গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীদের চালানো গবেষণায় এ সাফল্য আসার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

Advertisement

তবে এখনও এটিকে প্রাথমিক সাফল্য বলে মনে করছেন বিএফআরআই’র মহাপরিচালক ও দেশের খ্যাতিমান মৎস্য বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।

তার মতে, গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এক গবেষণায় প্রথমবারের মতো হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে পোনা উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। তবে এজন্য আরও গবেষণা দরকার। এ বিষয়ে আমরা শতভাগ সাফল্য পেলে দেশের অর্থনীতি তথা সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা হবে। আর এ লক্ষ্যে কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে।

মৎস্য বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, এর আগে গবেষণার মাধ্যমেই প্রথমবারে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে সাফল্য পান বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা। এখন দেশে কাঁকড়া পোনার সংকট নেই। গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় ভেটকিসহ অন্যান্য অর্থকরী মাছেরও কৃত্রিম উপায়ে পোনা তৈরির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

সূত্র মতে, বিএফআরআই কক্সবাজারে পরিচালিত ‘সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা জোরদারকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে’র অর্থায়নে ‘ভেটকি মাছের মা মাছ তৈরি ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন গবেষণা’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রকল্প চলছে। বিএফআরআই কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হকের নেতৃত্বে চলছে এ গবেষণা কাজ। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালানোর পর গত মে মাসে সর্বপ্রথম ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া যায়। আর গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজারের কলাতলী থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তাইল্যা ও কোরাল মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এবং সর্বোচ্চ প্রজননকাল চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।

বিএফআরআই’র তথ্য মতে, ভেটকি বা কোরাল দেশের উপকূলীয় এলাকার অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় বৃহৎ আকারের সামুদ্রিক মাছ। এ মাছ কম কাঁটাযুক্ত, দ্রুত বর্ধনশীল ও খেতে সুস্বাদু বলে বাজারমূল্যও বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ মাছের চাহিদা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলো গত ২-৩ দশক আগেই হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে ভেটকি পোনা উৎপাদনে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পিছিয়ে ছিলেন। অথচ কক্সবাজারসহ দেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ভেটকি মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত বলে বেশ কয়েকবছর আগেই মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশে সফররত একদল মালয়েশিয়ান বিজ্ঞানী।

অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের মাঝে চিংড়ির সঙ্গে কোরাল মাছেরও চাষ করা হয়। কোরাল মাছ লবণাক্ত, আধা-লবণাক্ত, এমনকি স্বাদু পানিতেও অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়। এ মাছের রোগ বালাই কম বলে সাম্প্রতিককালে অনেকেই চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে ভেটকি চাষ করে সফল হয়েছেন। তবে পোনা সংকটের কারণে এ মাছের চাষকে সম্প্রসারিত করা যাচ্ছিল না।

বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে কোরাল মাছের বৈজ্ঞানিকভাবে চাষ হয় না বললেই চলে। মে-জুন মাসে ঘের মালিকরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে কোরাল মাছের পোনা সংগ্রহ করে বাগদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের সঙ্গে সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করেন।

Advertisement

ভেটকির পোনা উৎপাদন গবেষণা প্রকল্পের প্রধান মোহাম্মদ আশরাফুল হক জানান, একটি পরিপক্ক স্ত্রী ভেটকি ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। ফলে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য স্বল্প সংখ্যক মা ভেটকিই যথেষ্ট।

তবে চ্যালেঞ্জ হলো মা ভেটকি তৈরি হওয়ার জন্য যে ৪-৫ বছর সময়টুকু দরকার, তা রক্ষা করতে হবে। ভেটকি মাছ প্রথমে পুরুষ হয়ে জন্মায় এবং ৪-৫ বছর পর কেউ কেউ স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। স্ত্রীতে রূপান্তরিত হওয়ার পরই তারা প্রজননের জন্য উপকূলের নদী মোহনার কাছে আসে।

বিজ্ঞানী আশরাফুল হক বলেন, কোরাল মাছের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি ডিম দেয় মে মাসে। গত ২৩ মে অবরোধের মাঝে সোনাদিয়া উপকূলে গবেষণা চালানোর সময় কোরাল মাছের ডিম পাড়ার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেন এবং এখান থেকে সংগৃহীত মা মাছ হ্যাচারিতে এনে কৃত্রিম উপায়ে পোনা উৎপাদনেও সক্ষম হয়েছেন বলে জানান তিনি।

তবে উৎপাদিত পোনার বেঁচে থাকার হার এখনও কাঙ্ক্ষিত মানের নয় মন্তব্য করে বিজ্ঞানী আশরাফুল হক এ বিষয়ে শতভাগ সাফল্য পেতে নিবীড় গবেষণা চলছে বলে উল্লেখ করেন।

‘সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা জোরদারকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে’র প্রকল্প পরিচালক ও কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহনূর জাহেদুল হাসান বলেন, ভেটকির ওপর গবেষণা চালাতে গিয়েই আমরা গত মাসে মহেশখালী চ্যানেল ও বাঁকখালী মোহনার ফাডার চরের আশপাশের আনুমানিক ২৩ বর্গ কিলোমিটার মোহনাঞ্চল জুড়ে তাইল্যা ও ভেটকি মাছের প্রজননক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছি। আমাদের গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল খুব শিগগিরই বিস্তারিতভাবে ঊর্ধ্বতন মহলে অবহিত করা হবে।

তিনি জানান, ২১ ডিগ্রি ২৮ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১ ডিগ্রি ৫১ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ হতে ২১ ডিগ্রি ২৯ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১ ডিগ্রি ৫৩ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২১ডিগ্রি ৪৮ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ হতে ৯১ ডিগ্রি ৫৭ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত এ প্রজননক্ষেত্রটি বিরাজিত। এলাকাটি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্ট হতে পশ্চিমে আনুমানিক ৮ কিলোমিটার দূরবর্তী সমুদ্র এলাকায় অবস্থিত এবং জেলেদের কাছে ‘ফাড়ার চর’ নামে পরিচিত।

শাহনূরের মতে, সাগর থেকে কোরাল মাছ আহরণে নিয়োজিত অভিজ্ঞ মাঝিদের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বঙ্গোপসাগরে ভেটকি মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সনাক্ত হয়। সরাসরি প্রজননকালে পরিপক্ক মা ভেটকি মাছ সংগ্রহ করার উদ্দেশে ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রতি মাসের অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জো (গুণ) পরবর্তী ৩-৪ দিন মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে এর বাস্তবতা পাওয়া যায়।

বিজ্ঞানীরা জানান, মূলত মহেশখালী চ্যানেল মোহনার ফাডার চর ভাটার সময় জেগে ওঠে ও জোয়ারের সময় নিমজ্জিত থাকে। এ চরের অগভীর এলাকায় আগত জোয়ারের পানিতে সান্ধ্যকালীন সময়ে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ পরিপক্ক ডিম ও শুক্রাণু ছাড়ে। তীব্র ঢেউ ও ঘূর্ণনের মধ্যে ডিম ও শুক্রাণুর মধ্যে বাহ্যিক নিষিক্তকরণের মাধ্যমে ভেটকি মাছের প্রজনন সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রজনন ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণুর প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ তৈলগ্রন্থি বিদ্যমান থাকায় নিষিক্ত ডিম সাগরের পানির উপরিস্তরে ভাসতে থাকে এবং জোয়ারের পানির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে এক সময় উজানের উপকূলীয় নদী-নালার কম লবণাক্ত পানিতে পৌঁছে। ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার মধ্যে এরা ডিম থেকে লার্ভা আকারে বড় হয়ে সোনাদিয়া, মহেশখালী, বাঁকখালী নদীর উজান দিকের খুরুশকুল, পেশকারপাড়া, এসএমপাড়া, চান্দেরপাড়া ইত্যাদি এলাকায় (জোয়ারের পানি যেখান পর্যন্ত যায়) অগভীর জলাশয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।

সায়ীদ আলমগীর/এমবিআর/জেআইএম