জাতীয়

স্মৃতি রোমন্থন করে আজও কেঁদে চলেছেন শাওনের মা

‘আমার ছেলে জাকির হোসেন শাওন। ওর ওপর আশা-ভরসা কইরা আমি ছিলাম। ও আমারে খাওয়াইত পড়াইত। এখন সরকার, অন্য কেউ আমারতো খোঁজ-খবর নেয় না? আমার ছেলে হত্যার বিচারতো পাইলাম না? আমার ছেলেতো কোনো অপরাধী না? এই লোকেরা (পুলিশকে দেখিয়ে) আমার ছেলেরে তুলে নিয়া ধইরা নির্মমভাবে মারছে। সরকারের লোক দেইখা? আমি অসহায় বইলা। গরিব মানুষ দেইখা? নির্যাতন কইরা মাইরা আমার বুকের ধন কাইরা নিছে।’

Advertisement

আজ সোমবার (১ জুলাই) দুপুরে হামলার তিন বছর উপলক্ষে গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে এসে সাংবাদিকদের সামনে আহাজারি করেন বেকারির নিহত কর্মচারী জাকির হোসেন শাওনের মা মাকসুদা বেগম। এ সময় তিনি সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতনে ছেলেকে হত্যায় পুলিশকে অভিযুক্ত করেন এবং ছেলে হত্যার বিচার চান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, জাকির হোসেন শাওন হলি আর্টিসানের বাবুর্চির সহকারী ছিলেন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসানে হামলার সময় সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে শাওনকে আটক করে পুলিশ। পরে ঘটনার একদিন পর শাওন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ঘটনার তদন্তে দুই বছরের মাথায় উঠে আসে শাওন জঙ্গি ছিলেন না, নির্দোষ ছিলেন। এ বিষয়ে শাওনের পরিবারের পক্ষ থেকে তখনই অভিযোগ করে বলা হয়, শাওনকে জঙ্গি মনে করে পুলিশ নির্যাতন করে হত্যা করেছে।

Advertisement

প্রতি বছরই এ দিনটিতে তিনি হলি আর্টিসান বেকারিতে আসেন। নিজের ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন। স্মৃতি রোমন্থন করে আহাজারি করেন।

সোমবার দুপুরে মাকসুদা বেগম বলেন, ‘আমি এত (নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ) দূর থেকে আসলাম। আমি তো পাপী না। আমরা গরিব সাধারণ মানুষ। বেঁচে থাকতে চাইছিলাম। আমার সব শেষ করে ফেলছে। আজ আমি কাঁচামরিচে ভাত খাবার পাই না। কেন? কেন সরকার আমারে প্রতিদান দিল না। নিরপরাধী ছেলেটা এখানে আসছিল চাকরি করতে। আমি বিচার চাই। নইলে আমগোরে মাইরালান। আমাকে, আমার বুড়ো স্বামীরে, মাইরালান। আমগো বাঁচার কোনো অধিকার নাই। নিষ্পাপ এই শিশু (শাওন), পেটের ক্ষুদা মেটাতে এইখানে আসছিল। সন্দেহ কইরা আমার ছেলের জীবনটা শেষ করে দিল।’

সাংবাদিকদের উদ্দেশে শোকসন্তপ্ত এ মা বলেন, ‘আমি কার কাছে বিচার চামু বাবা। আমি তিন বছর ধরে অসুস্থ। কখন যে ছেলের শোকে মারা যাই তার ঠিক নাই। বিচারটা যদি দেইখা যেতে পারতাম! তাও পামু না? সন্দেহ কইরা সবারে মাইরালাইব? তাদেরকে কি একটু সময় দিব না? হলি আর্টিসানের মালিকওতো আমার ছেলেকে চিনে। কই আমার ছেলেরে তো আমার বুকে ফেরায় দিল না?’

সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কমু, আল্লাহ… গাফুরুর রহিম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার বুকের ধন নিষ্পাপ ছেলেকে যারা কাইরা নিল, যেই পুলিশরা...আল্লাহ, তুমি তার বিচার কইরো আল্লাহ। আমার কলজাটারে ফাটাই ফালছে।’

Advertisement

শাওনের মা আরও বলেন, ‘যে ছেলেটা মইরা গেল, তার ছেলে ও বাবা কী করে, কী কইরা খায় কেউ খোঁজ নিল না। ছেলেডা মইরা গেল, কাঁচের গ্লাসের মতো বুকটা ভাঙ্গগা দিল। টর্চার করছে। গোরস্থানে নেয়ার আগে হাসপাতালে ভর্তি করছে। দুদিন পর আমার ছেলে নাই। কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই নাই। কেউ আসেনি। এই হলি আর্টিসানের মালিক মাসে ৫ হাজার করে টাকা দেয়। সেই টাকায়তো বাসা ভাড়াই হয় না।’

আর্থিক সাহায্যের আশায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানালেও কোনো সাড়া পায়নি শাওনের পরিবার। শাওনের মা রাস্তায় পিঠা বিক্রি করে সংসার চালাতেন, কিন্তু এখন নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আর পিঠা বিক্রির কাজ করতে পারছেন না। শাওনের ছোট বোন পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। তার দেয়া টাকায় চলছে সংসার।

মাকসুদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেডা নির্মমভাবে পুলিশ মারল সন্দেহ কইরা। দুই বছর পর জানলাম আমার ছেলে নির্দোষ। তাহলে আমার ছেলে হত্যার বিচার কেন হইল না? কত বার কইছি মাগো (প্রধানমন্ত্রী) আমার ছেলে হত্যার বিচার কেন পাইব না? আমার ছেলেকে কারেন্ট শক দিয়া মাইরালছে। বিচার না করেন, নইলে আমারে মাইরালান। আমি তিনটা বছর অপেক্ষা করছি। এই ছেলের জন্য আমার ঘরে অন্ধকার ভর করছে। মৃত্যু সংবাদের কোনো আচার-বিচার নাই? পুলিশের কোনো মায়া-দয়া নাই।’

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় জিম্মি করে ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা। জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে অভিযানে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে পাঁচ হামলাকারী জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হন।

হামলার পর প্রায় সাড়ে চার মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে হলি আর্টিসান প্রাঙ্গণ। ওই বছরের নভেম্বরে রেস্তোরাঁটি মালিকপক্ষকে বুঝিয়ে দেয় পুলিশ।

হলি আর্টিসান মামলার রায়ের সব খবর পড়ুন এক ক্লিকে

জেইউ/এসআর/আরআইপি