মতামত

ভেজালে বিভ্রান্তি!

গত ২৬ জুন দৈনিক প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠার দুটি সংবাদ দেখে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তৃতীয় পৃষ্ঠার নিচের বাদিকের সংবাদের শিরোনাম ’১৪ ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে ক্ষতিকর উপাদান নেই: বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা’। তার ঠিক ডান পাশেই শিরোনাম ’৭১ ভোগ্যপণ্যের ৬৯টিই মানহীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা’। ডান পাশের নিউজের সাথে কিছু উপ-শিরোনাম আছে- পরীক্ষায় পাস্তুরিত তরল দুধের ৭টি নমুনাতেই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, অপাস্তুরিত তরল দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়নি, হলুদের দুটি নমুনা ছাড়া বাকি সব পণ্যেই ভেজাল অথবা ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গেছে।

Advertisement

এখন আপনারাই বলুন, আমি কোনটা বিশ্বাস করবো, আপনারা কোনটা বিশ্বাস করবেন? বিএসটিআই সরকারি প্রতিষ্ঠান। চাইলে তাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা সম্ভব। আমি বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু তিনদিন পর ২৯ জুনের প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠা দেখে আমার মাথার চুল ছেড়ার দশা। ২৬ জুন যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, সে পরীক্ষাটি করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ ও অনুষদভুক্ত বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার।

রিপোর্ট প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সেন্টারের পরিচালক আ ব ম ফারুক, ফার্মানিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ ও ফার্মেসি অনুষদের ডিন এস এম আবদুর রহমান। কিন্তু ২৯ জুনের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ‘ভোগ্যপণ্যের মান গবেষণা প্রসঙ্গে মতবিরোধ’। এই সংবাদে বলা হয়, ভোগ্যপণ্যের মান নিয়ে যে গবেষণা, তার দায়িত্ব নিচ্ছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ। বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার এই দাবি করেছেন। এইবার বলেন, আমরা কই যাবো?

ইদানীং চারদিকে একটা সাজ সাজ রব। চারদিক ভেজালে সয়লাব। দেখে মনে হতে পারে হঠাৎ ভেজাল বেড়ে গেছে। আসলে ভেজাল বাড়েনি, যা ছিল তাই আছে; আমাদের ভেজালবিরোধী তৎপরতা বেড়েছে। হাইকোর্ট তৎপর, বিএসটিআই তৎপর, কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব তো আগে থেকেই তৎপর। মাঠে নেমেছে র্যাব, সিটি করপোরেশন, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। গণমাধ্যম তো আগে থেকেই সোচ্চার, আওয়াজ উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

Advertisement

সব মিলিয়ে চারদিকে ভেজালবিরোধী সচেতনতার ঢেউ। বিলম্বে হলেও এই জাগরণটা দরকার ছিল। নিরাপদ খাদ্য আমাদের এক নাম্বার মৌলিক চাহিদা ও অধিকার। সমস্যা হলো, যে কোনো সাঁড়াশি অভিযানের শুরুতে অনেক নিরপরাধ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রবল ঢেউ ভাসিয়ে নেয় ভালো-মন্দ সবকিছু।

ভালো-মন্দের ভেদাভেদ ঘুচে যায়। যেমন মাদকবিরোধী অভিযানের শুরুতে মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে কিছু নিরীহ মানুষও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এখন আমরা আমের মৌসুমে নিশ্চিন্তে আম খেতে পারছি, কয়েকবছর আগে আমের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগান থেকে ঢাকার বাজার পর্যন্ত ছিল কঠোর নজরদারি। কার্বাইড দিয়ে পাকানোর অভিযোগে টনকে টন আম ধ্বংস করা হয়েছে। নষ্ট করা আমের সবগুলো কিন্তু খারাপ ছিল না। আপনি আমি যে এখন ভালো আম খাচ্ছি, তা কিন্তু অনেক নিরপরাধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর নিঃস্ব হওয়ার বিনিময়ে। ভেজালবিরোধী অভিযানটা এত জনপ্রিয় যে এ অভিযানে ভুল হলেও তা বলা যায় না।

না বলার আরো একটা বড় কারণ হলো, ভেজালবিরোধী অভিযানে ভুল বা বাড়াবাড়ি হতে পারে। কিন্তু অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে কারো সংশয় থাকে না। তাই বৃহত্তর স্বার্থে আমরা চুপ করে থাকি। তবে গত রমজানের আগে আদালতে দেয়া বিএসটিআইয়ের দুটি প্রতিবেদন একই সঙ্গে শঙ্কিত ও আশ্বস্ত করেছে। বিএসটিআইয়ের প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০৬টি পণ্য সংগ্রহ করে ৩১৩টি পরীক্ষা করে ৫২টি পাওয়া যায় নিম্নমানের। দ্বিতীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৩টি পণ্যের মধ্যে ২২টিই নিম্নমানের। বিএসটিআইয়ের মানহীন ৫২ পণ্যের তালিকা প্রকাশের পর রীতিমত বোমা ফাটে। আমরা শঙ্কিত হই, কারণ দুই দফায় বিএসটিআই ঘোষিত ৭৪টি পণ্যের মধ্যে বেশিরভাগই নামকরা কোম্পানির এবং বেশ জনপ্রিয়।

Advertisement

প্রথম তালিকা প্রকাশের পর তার একটি কপি আমি পকেটে রাখতাম। যাতে বাজারে গেলে তালিকা মিলিয়ে বাদ দিতে পারি। কিন্তু দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশের পর কিছুটা হাল ছেড়ে দেই। ৭৪ পণ্যের তালিকা পকেটে নিয়ে বাজারে যাওয়া কঠিন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালণয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের ৫৯ মানহীন পণ্যের তালিকা প্রকাশের পর কঠিন কাজটি অসম্ভব হয়ে যায়। ১৩৩টি পণ্যের তালিকা নিয়ে তো আর বাজারে যাওয়া সম্ভব নয়। তারচেয়ে ভালো এতদিন যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলুক; ভেজাল আমাদের সয়ে গেছে। কিন্তু বাজারে প্রচলিত ১৩৩টি পণ্যই মানহীন এটা সত্যিই আশঙ্কার।

বিএসটিআই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টের পর অভিযুক্তদের কেউ কেউ দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার দোহাই তুলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার অবস্থান পরিষ্কার, শিল্প দেশী হোক আর বিদেশী, পণ্য হতে হবে মানসম্পন্ন। পয়সা আমি যা কিনবো তা নিরাপদ হতে হবে। এ নিয়ে আপোসের কোনো সুযোগ নেই। চীনে আমরা দেখেছি, দুধে মেলামিনের উপস্থিতির বিরুদ্ধে কী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। আমরাও ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু রমজান মাস নয়, ভেজালবিরোধী অভিযান চলতে হবে বছরজুড়ে। শুধু রমজানে ভালো খাবার খাবো, আর বাকি সময় ভেজাল খাবো, তা তো নয়।

বিএসটিআই বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্ট দেয়ার আগেও আমরা জানি খাবারে ভেজাল দেয়া হয়। আর ভেজাল দেয়া হয় বলেই, আমাদের ক্যান্সারসহ নানা অসুখ বেড়েছে। তাই নিজেদের স্বার্থেই আমাদের ভেজালের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ভেজালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেন অপ্রয়োজনে কাঠিন্য আরোপ করা না হয়। ঠগ বাছতে গা উজাড় করে ফেললে আমরা খাবো কী? তবে বাঁচার জন্য খেতে গিয়ে ভেজাল খেয়ে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করাও কোনো কাজের কথা নয়। এই ভারসাম্যটা বজায় রাখতে হবে নিপুণভাবে। বাংলাদেশের বিএসটিআইকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন- এফডিএর মানে উন্নীত করতে হবে। আর একটি প্রতিষ্ঠানই যেন মানের ব্যাপারে মানদণ্ড নিশ্চিত করে।

আজ বিএসটিআই, কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরশু আরেক প্রতিষ্ঠান যদি পণ্যের মানের সার্টিফিকেট দিতে শুরু করে, তা শুধু বিভ্রান্তিই ছড়াবে। ভেজালের বিরুদ্ধে লড়াই তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিভ্রান্তির সুযোগ নেবে অসৎ কোম্পানিগুলো। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে নামী কোম্পানিও। ভেজালবিরোধী অভিযানে যেন কোনো ভেজাল না হয়, বিভ্রান্তি না হয়।

এইচআর/এমকেএইচ