খেলাধুলা

ভারত ম্যাচের আগে ঘুরেফিরে সবার মুখে ‘মাশরাফি’

আসুন না টাইম মেশিনে একটু পেছনে ফিরে যাই। সময়কাল, ২০০৪ সালের ডিসেম্বর।

Advertisement

২৬ ডিসেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের সাথে দ্বিতীয় ওয়ানডের পর তখনকার ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে নয়, ভারতীয় প্রচার মাধ্যম মিডিয়া বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কজন কাছের সাংবাদিকের সাথে একান্ত আলাপে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আরে, আমাকে রিজার্ভ বেঞ্চে কীসব প্লেয়ার দেয়া হয়েছে! বাংলাদেশ দলের ওই সুঠামদেহী উচ্ছ্বল তরুণ কৌশিককে দেখো। কী দারুণ ক্রিকেটার! যেমন জোরে বল করে আর ব্যাট হাতেও কম যায় না। হাত খুরে মারতে পারে, বিগ হিটটাও ভালো নেয়। ওই এক কৌশিকের মত যদি আমাদের একটি ছেলেও থাকতো, তাহলে আর কথাই ছিল না।’

আগেই বলে দেই, তখন ভারতীয় দলে আর সবার সাথে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে ছিলেন লক্ষী রতন শুক্লা। মূলত তাকে ইঙ্গিত করেই মহারাজ অমন আক্ষেপ করেছিলেন।

আচ্ছা অনুমান করুন তো, ভারতের তখনকার অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি আজ থেকে ১৫ বছর আগে কেন তখনকার কৌশিকের (মাশরাফি বিন মর্তুজা) অমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে খেদোক্তি করেছিলেন?

Advertisement

বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। পরিসংখ্যান নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি না করেও বলে দেয়া যায়, ওই সফরেই ভারত-বাংলাদেশের কাছে প্রথম ওয়ানডেতে হার মানে।

ইতিহাস পরিষ্কার জানাচ্ছে, ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে জয়ী হয় বাংলাদেশ। হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ১৫ রানে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক জয়ের মধুর স্বাদ পায়। সে জয়ের অন্যতম রূপকার ও স্থপতি ছিলেন মাশরাফি। মাশরাফির একার অলরাউন্ড নৈপুণ্যের কাছেই আসলে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল ভারতীয়রা।

প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ করেছিল ৯ উইকেটে ২২৯ রান, যাতে মাশরাফির অবদান ছিল ৩৯ বলে ৩১। ৯ নম্বর পজিশনে নামা মাশরাফির ওই ইনিংসটির ওপর ভর করে ২০০ ‘তে পা রাখে বাংলাদেশ। আর তারপর বল হাতে ৯ ওভারে ২ মেডেনসহ ড্যাশিং ওপেনার বীরেন্দর শেবাগ আর মহেন্দ্র সিং ধোনির উইকেট নিয়ে ভারতকে ২১৪ রানে বেঁধে ফেলার মিশনেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মাশরাফি।

আর তারই পুরস্কার হিসেবে ম্যাচসেরা হন নড়াইলের সেদিনের ২১ বছর বছর বয়সী উচ্ছ্বল তরুণ কৌশিক। তার পারফরমেন্স মনে ধরে ভারতীয় অধিনায়ক মহারাজের। আর তাইতো কৌশিকের পারফরমেন্সের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন সৌরভ।

Advertisement

তার মানে কী দাঁড়াল? ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক মাশরাফি। ভাববেন না সেটাই মাশরাফির প্রথম ও শেষ ভারত বধে নায়ক হওয়া ।

এরপর মাশরাফি আরও একবার ভারতের বিপক্ষে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন। সেটা আরও বড় আসর, বিশ্বকাপে। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিনিদাদের পোর্ট অফস্পেনে। ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং-তিন শাখায় ভারতের ওপর পরিষ্কার প্রাধান্য বিস্তার করে ৫ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয় পায় বাংলাদেশ। সেই দুর্দান্ত টিম পারফরমেন্সের মাঝেও সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন মাশরাফি।

নতুন করে বলার হয়তো আর প্রয়োজন নেই, বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। আর সেই ঐতিহাসিক জয়েও বিধ্বংসী বোলিংয়ে ৩৮ রানে ৪ উইকেটের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন মাশরাফি। ওই ম্যাচে ৯.৩ ওভারে দুই মেডেনসহ ৩৮ রানে ৪ ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে ভারতকে ১৯১ রানে বেঁধে ফেলায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।

২০০৪ সালে দেশের মাটিতে ভারতকে প্রথম হারানোর ম্যাচে যাকে ফিরিয়ে প্রাথমিক ব্রেক থ্রু উপহার দিয়েছিলেন, ঠিক তিন বছর পর ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে বিশ্বকাপে ভারতকে প্রথম হারানোর ম্যাচেও সেই ড্যাশিং ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দর শেবাগকে আউট করে আবার ভারতকে প্রাথমিক চাপে ফেলে দেন। পরে রবিন উথাপ্পা, অজিত আগারকার ও মুনাফ প্যাটেলকে সাজ ঘরে ফিরিয়ে ম্যাচ সেরা হন মাশরাফি।

আগে কখনো বাংলাদেশের কাছে হার না মানা ভারত, তিন বছরের ব্যবধানে দুই দুই ধাক্কা খেলো বাংলাদেশের কাছে। যার দুটিরই ম্যাচসেরা মাশরাফি। এই যে মাশরাফির নাম গেঁথে গেল সব ভারতীয় ক্রিকেট ভক্ত ও সমর্থকের মনে। সবাই জানলেন, বাংলাদেশে এক দারুণ পারফরমার আছে, যার বোলিং আর ব্যাটিং ভারতকে ভোগায়। হারায়। সেই থেকে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলায় 'এক্স ফ্যাক্টর' মাশরাফি।

তারপরও অবশ্য বাংলাদেশ আরও তিনবার ভারতকে হারিয়েছে। তবে মাশরাফি আর সে জয়ের ম্যাচসেরা হতে পারেননি। ২০১২ সালের ১৬ মার্চ এশিয়া কাপে বাংলাদেশ আবার ৫ উইকেটে হারায় ভারতকে। সেবার ম্যাচ সেরা হন সাকিব ঝড়ের গতিতে ৩১ বলে ৪৯ রান করে।

আর ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে ভারতকে তিন ম্যাচের সিরিজে ২-১ ‘এ হারায় বাংলাদেশ। যার প্রথমটিতে ৫০ রানে ৫ উইকেট শিকার করে ম্যাচসেরা হন মোস্তাফিজুর রহমান। পরের ম্যাচে আবার মোস্তাফিজ ম্যাজিক। ৪৩ রানে ৬ উইকেট দখল করে আবার ভারত বধের নায়ক কাটার মাস্টার।

যদিও ২০১২ আর ২০১৫ ‘তে ভারত বধ মিশনে মাশরাফি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেননি, তারপরও ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ হলেই উঠে আসে নড়াইল এক্সপ্রেসের নাম।

২ জুলাইয়ের ‘হাই ভোল্টেজ’ ম্যাচের আগেও এই মাশরাফির দিকেই তাকিয়ে বাংলাদেশ ভক্তরা। ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের মুখেও ঘুরে ফিরে আসছে টাইগার দলপতির নামটিই। ভারতের নামী ও সিনিয়র সাংবাদিক দেবাশীষ দত্ত আর গৌতম ভট্টাচার্য্যর মুখেও বার বার মাশরফির কথা।

তারা জানেন, এবারের বিশ্বকাপে মাশরাফি সেভাবে বল হাতে আগুন ঝরাতে পারেননি। ম্যাচ জেতানো বোলিং বহুদূরে, উইকেট পেতেই কষ্ট হচ্ছে এ অভিজ্ঞ যোদ্ধার। ৬ খেলায় তার ঝুলিতে জমা পড়েছে ১টি মাত্র উইকেট। তারপরও ভারতীয় শিবিরে যত চিন্তা মাশরাফিকে নিয়ে।

তাদের সবার একটাই কথা, এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেভাবে নিজেকে খুঁজে পাননি-তাতে কী? মাশরাফি এখনো বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে 'এক্স ফ্যাক্টর'। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কার কী গুণ, কোথায় দুর্বলতা, তা মাশরাফির চেয়ে আর ভালো জানেন কে?

তাই এজবাস্টনে ভারতীয় টপ অর্ডারের চিন্তার নাম মাশরাফি। তার এক স্পেলেই পাল্টে যেতে পারে ম্যাচের চালচিত্র। এখন দেখার, নিজের সবচেয়ে পছন্দের প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আগের সেই ভয়ংকর চেহারায় মাশরাফি হাজির হতে পারেন কি না!

এআরবি/এমএমআর/এমএসএইচ