আইন-আদালত

গতি বাড়ছে বিচার বিভাগের

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিচার বিভাগের গতি বেড়েছে। সুপ্রিমকোর্টসহ দেশের সব আদালতে দীর্ঘদিনের জমে থাকা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন দেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। যিনি এস কে সিনহা হিসেবে সমধিক পরিচিত।প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা দ্বায়িত্ব গ্রহণ করার পর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে কর্মঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আগে সকাল নয়টা থেকে অফিস করতেন, কিন্তু এখন অফিসে আসেন সকাল আটটায়। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় সার্কুলার জারি করে সুপ্রিমকোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মঘণ্টা এগিয়ে এনে সকাল আটটায় সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়। দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিতদের আইনি সেবা প্রদান করার জন্য সুপ্রিমকোর্টের একটি ভবনে গত ৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লিগ্যাল এইড সার্ভিস সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে। যেসব আসামি কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি আছেন কিন্তু আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ নেই তাদের মামলাসহ অন্যান্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মামলা নিয়ে এই লিগ্যাল এইড কমিটি কাজ করবেন।একই সঙ্গে গত জুন মাসের দিকে  সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার পদের থেকে রেজিস্ট্রার জেনারেল পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে নিম্ন আদালতের বিচারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অধস্তন কর্মচারীদের, আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে সার্কুলার জারি করেছেন সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। দেশের আদালত সমূহে কর্মরত সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে এই সার্কুলার জারি করেন সংশ্লিষ্টরা।গত ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে হাইকোর্টের একটি সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনাধীন মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, "হাইকোর্টের একটি সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের বিষয়টি সংবিধানেই সন্নিবেশিত রয়েছে এবং আমি ইতোমধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি এবং সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের সাথে আলোচনা করে অবশিষ্ট করণীয় সম্পন্ন করা হবে।” এর আগে প্রধান বিচারপতিকে দেয়া সংবর্ধনা সভায় গত ১৭ আগস্ট রজশাহীতে তিনি বলেছেন, বিভিন্ন আদালতে বিচারের অপেক্ষায় থাকা ৩০ লাখ মামলার মধ্যে বিগত ছয় মাসে ২৬ থেকে ৪০ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আমি আশা করি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৫০ ভাগ মামলা নিষ্পত্তি হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে বাকি ৫০ ভাগ মামলার জট কমে যাবে।প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্য আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থীদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শম রেজাউল করিম বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর বিচার বিভাগের বন্ধ্যত্ব দূর করার জন্য এবং বিচার বিভাগীয় প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। যার ফলে ইতোমধ্যেই অনেক ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রেখে বিচার বিভাগকে তথ্য ও প্রযুক্তি সম্মত উপায়ে ঢেলে সাজাতে পারলে বিচার বিভাগ আরো অনেক সমৃদ্ধ হবে।সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্ব হাতে নেয়ার পর উচ্চ আদালত এবং দেশের অধস্তন সব আদালতের মামলা ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই ফলশ্রুতিতে চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) সুপ্রিমকোর্টের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১১ লাখ ২৬ হাজার একশ’ কোটি টাকা।বরাদ্দকৃত অর্থ যেসব খাতে ব্যয় করা হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- একটি স্বতন্ত্র বাজেট অনুবিভাগ প্রতিষ্ঠাকরণ, মামলা ব্যবস্থাপনায় আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের মামলা সমূহ দ্রুত ও পরিপূর্ণ নিষ্পত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা, অাধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে অধস্তন আদালত সমূহকে অনলাইন সেবার আওতায় এনে বিচারাধীন মামলাসমূহ যথাসময়ে নিষ্পত্তি করে বিচারিক কার্যক্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি, সুপ্রিমকোর্টের জাজেস লাইব্রেরি আধুনিকীকরণ এবং লাইব্রেরি ব্যবস্থাকে অটোমেশনকরণ, সুপ্রিমকোর্ট ভবনসমূহ ও প্রাঙ্গণে আধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি স্থাপন ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ, একটি মেডিকেল সেন্টার স্থাপন এবং একটি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ও মিনি পরিবহন পুল স্থাপন। সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতরের তথ্যানুযায়ী- উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে ইতোমধ্যেই সুপ্রিমকোর্টের সীমানা প্রাচীর সম্প্রসারণ ও ঊর্ধ্বমুখী করা হয়েছে। কোর্টের আঙিনায় গেট নির্মাণ এবং কোর্টের ভবনগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে এর সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টে স্থাপিত ডাটা সেন্টারের গতি বৃদ্ধি করে ১২ এমবিপিএস এ উন্নীত করা হয়েছে। একইসঙ্গে সারাদেশের আদালতসমূহের সঙ্গে ডাটা লিংক স্থাপনের কাজ চলছে। সুপ্রিমকোর্টের সম্প্রসারিত অংশে কিছু কিছু ভবন অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কোর্টের শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে হাইকোর্টে ৫৪টি বেঞ্চে বিচারিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিমকোর্টের কার্যতালিকা নিয়মিত ওয়েবসাইটে আপলোড করার জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। আগের আবেদনের শুনানি আগে ভিত্তিতে কার্যতালিকায় থাকা সংক্রান্ত এ নির্দেশনার কারণে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি অনেকাংশে লাঘব হবে বলে মনে করছেন আইন সংশ্লিষ্টরা। সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতরের তথ্যানুযায়ী- বর্তমানে দেশে উচ্চ আদালত এবং নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মোট ৩০ লাখ মামলা রয়েছে। তবে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে দেশের সব আদালতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে গঠন করা হয়েছে কেস ম্যানেজমেন্ট কমিটি। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করছেন প্রধান বিচারপতি। গত মাসে রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলা সফর করেন তিনি।সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতে ইতোমধ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে লোকবল নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। উচ্চ আদালত এবং নিম্ন আদালতের মামলাজট, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং অন্যান্য সব সমস্যার দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। সুপ্রিমকোর্টের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী অবকাঠামোগত সমস্যা নিরসন করে উচ্চ আদালতের বেঞ্চের অভাব দূর করতে একটি ২০ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া মেডিকেল সেন্টার, সিএনজি স্টেশন এবং মিনি পরিবহন পুল নির্মাণের জন্য আমাদের কর্মকর্তারা প্রধান বিচারপতির নির্দেশে কাজ করছেন।সৈয়দ আমিনুল ইসলাম আরো বলেন, উচ্চ আদালত এবং অধস্তন আদালতগুলোর উন্নয়নে প্রধান বিচারপতি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। আদালতের বিচারকের সংখ্যা, আদালত কক্ষের সংখ্যা এবং আধুনিকায়নের দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া হচ্ছে। আমরা একইসঙ্গে অফিস ম্যানেজমেন্ট, কেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করছি।এফএইচ/আরএস/আরআইপি

Advertisement