পরিচয়পত্র দেখে পাশা ভদ্রমহিলার লাশকে চিনতে পেরেছে। ভদ্রমহিলার নাম সেলিনা রদ্রিগেজ। বয়স ২১ বছর। জন্ম ভেনেজুয়েলায়। উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। ওজন প্রায় ৫০ কেজি। দীঘল কালো চুল। ফর্সা তার গায়ের রং। পরিচয়পত্র দেখে পাশার ভদ্রমহিলার কথা সাথে সাথে স্মরণ হয়।
Advertisement
ইউরোপ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় আসার পর সেলিনার সাথে পাশার দেখা হয় কলম্বিয়ায়। সেলিনা ও তার পরিবারের কিছু সদস্য ভেনেজুয়েলা থেকে পালিয়ে কলম্বিয়ায় মাত্র এলো। ওইদিন পাশা দেখল সেলিনা ও তার পরিবার পাচারকারীদের সঙ্গে কী যেন ফিসফিস করে বলছে। এরপর সেলিনা কিছু অর্থ পাচারকারীদের দেয়। পাশা সব দেখেছে। পাশা ভাবল, এরাও হয়তো তার মত কোথাও যাওয়ার জন্য পাচারকারীদের সাথে চুক্তি করছে। পাশা পরে জানতে পারে, কয়েক বছর হলো ভেনেজুয়েলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেলিনারা একসময় অনেক ধনী ছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে তার পরিবার সর্বস্ব হারায়। তাই ভালো জীবন যাপন করার ইচ্ছায় তারা দেশ ত্যাগ করে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।
কলম্বিয়ায় পাশার সাথে যখন সেলিনার দেখা হয়; তখন পাশা সেলিনার কোলে একটা বাচ্চা সন্তান দেখেছে। বাচ্চাটি এখন কোথায়? পাশা ভাবল। পাশা মরুভূমিতে সেলিনার লাশের পাশে বসে চারিদিকে তাকাল। কিন্তু সে আর কোন লাশ দেখেনি।
কলম্বিয়ায় পাশা যখন ক্ষুধার্ত ছিল; সেলিনা পাশাকে তার হাতের রুটির অর্ধেকটি দেয়। সেলিনার বাবা তাকে পানির একটা বোতলও দেয়। ওই অর্ধেক রুটি এবং পানি খাওয়ার পর পাশা যেন তার জীবন ফিরে পায়। মানবিকতার এমন উদাহরণ দেখে পাশার বুকে তখন অনেক সাহস জোগায়।
Advertisement
সবকিছু স্মরণ করার পর পাশা নিজেকে মনে মনে অনেক ধিক্কার দেয়। ‘শেষ পর্যন্ত মেয়েটির কলিজা, ফুসফুস এবং লিভার বুঝি আমাকে খেতে হলো।’ পাশা ভাবল। পাশা আরও ভাবল, ‘মৃত্যুর পরেও মেয়েটি আমার জীবন আরেক বার ফিরিয়ে দিলো।’
পাশার শরীরে এখন একটু শক্তির সঞ্চার হয়। উঠে দাঁড়িয়ে পাশা আবার হাঁটতে শুরু করে। এভাবে সে কয়েকদিন মরুভূমির উপর হাঁটল। পথ যেন ফুরায় না। পরে পাশা মরুভূমিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখে। কিন্তু পাশা মনে মনে ভাবছে যে, তার যত কষ্ট হোক সে আর মানুষের মাংস কিছুতেই খাবে না। এভাবে আরও চারদিন কেটে যায়। পাশা আর কিছু খেতে পেল না। পঞ্চম দিন বিকেলে পাশা মরুভূমি থেকে দূরে লোকালয় দেখতে পেল। খুশিতে সে যেন আত্মহারা। অবশেষে তার কষ্টের দিনে শেষ হতে চলেছে।
প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর সে আরেকটি লাশ মরুভূমিতে দেখতে পায়। গত কয়েকদিনে পাশা বহু লাশ দেখেছে। কিন্তু লাশটি একটু ভিন্ন। লাশটি তেমন গলেনি। দেখতে অনেকটা সেলিনার মত। উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চির মত হবে। ওজন প্রায় ৫০ কেজির বেশি হবে না। তারও দীঘল কালো চুল। ফর্সা গায়ের রং। দেখে পাশার কেন জানি খুব লোভ লাগে। উপরন্তু তার ভীষণ ক্ষুধাও লেগেছে। পাশা তার হাতের ছুরি দিয়ে মেয়েটির বুক চিড়ে। তারপর মেয়েটির কলিজা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে। কিন্তু কেন জানি তার কাছে এ কলিজা খেতে আর ভালো লাগছে না। ‘লাশটি এখনো অনেক ফ্রেশ।’ পাশা ভাবল। ‘সেলিনার লাশটি শুকনো ছিল। আর সেলিনার কলিজা, ফুসফুস এবং লিভার সূর্যের তাপে অনেকটা পোড়া ছিল। তাই বোধ হয় খেতে ভালো লেগেছিল।’ পাশা মনে করার চেষ্টা করে। তাই পাশা নতুন এই কলিজার সামান্য অংশ খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করে।
তিন ঘণ্টা হাঁটার পর সে টেক্সাসের ফোর্ট ডেভিস শহরে পৌঁছায়। পাশার কাছে অনেক ডলার ছিল। মরুভূমিতে যতগুলো লাশ দেখেছে, সবার পকেট থেকে পাশা সব অর্থ নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। শহরের কাছে এসে পাশা মুগ্ধ হয়ে এদিক ওদিক দেখছে।
Advertisement
‘আমি কি কোন স্বর্গে এলাম? কী সুন্দর এই শহর। কত সুন্দর সুন্দর গাড়ি। কত রকমের নীল, লাল বাতি জ্বলছে। মানুষগুলো দেখতে কত সুন্দর।’ পাশা ভাবল।
পাশার গায়ের পোশাক ময়লা ও বালুতে পরিপূর্ণ। পাশা শহরের রাস্তা দিয়ে যখন এদিক ওদিক হাঁটছে সাধারণ জনগণ তাকে হোমলেস ভেবে এড়িয়ে চলে। পাশা ভাবল, তাকে নতুন জামা-কাপড় কিনতে হবে। কিন্তু কিভাবে? পাশা তো ইংরেজি বলতে পারে না। পরে সাহস করে পাশা একটি কাপড়ের দোকানে ঢোকে। একটি জিন্সের প্যান্ট এবং টি-শার্ট নিয়ে ক্যাশিয়ারকে পাশা অনেকগুলো ডলার দেয়। ক্যাশিয়ার পাশাকে বাকি ডলার ফেরত দেয়। দোকানটির বাথরুমে ঢুকে পাশা তার পোশাক পরিবর্তন করে। হাত-মুখও ভালোভাবে ধুয়ে নেয়।
কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পাশা একইভাবে রাস্তার এক খাবারের দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে নিয়ে খেতে শুরু করে। পাশা কী কিনল সে নিজেও জানে না। দোকানদারকে হাতের ইশারা দিয়ে অনেক খাবার কিনে নেয়। খাবার শেষ করে বাকি খাবার তার কাছে রাখে। এরপর ফোর্ট ডেভিস শহরের রাস্তায় হাঁটা শুরু করে। কিন্তু এখন সে কী করবে বুঝতে পারছে না। আশেপাশে কোন বাঙালি দেখছে না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। অন্যদিকে মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি রাস্তায় দেখলে তার বুক থরথর করে কাঁপতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে পাশা শহরের ভেতরের দিকে প্রবেশ করে।
হঠাৎ পাশা একজন বাঙালিকে দেখতে পায়। দেখে পাশা আনন্দে কাঁদতে লাগল। বহুদিন পরে একজন বাঙালির সাথে তার দেখা হয়। বাঙালি ভদ্রলোক পাশাকে বলে, ‘ভাই, এখানে বেশি বাঙালি নাই। আপনি নিউইয়র্কে যান। নিউইয়র্কে প্রচুর বাঙালি থাকে। তাছাড়া নিউইয়র্ক পুলিশ অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করে না। আপনি নিউইয়র্কে অনেক নিরাপদে থাকবেন।’‘কিন্তু ভাই, আঁর তো নিউইয়র্কে কেহ নাই। যাবার পথও চিনি না। আন্নে যদি আঁরে একটু সাহায্য করতেন।’ পাশা বলল।ভদ্রলোক বলল, ‘ঠিক আছে। এখান থেকে একটি বাস আছে, যেটি সরাসরি নিউইয়র্ক যায়। আপনি এই বাসে উঠলেই হবে। সোজা নিউইয়র্কে পৌঁছে যাবেন।’‘চলুন, আপনাকে বাসে উঠিয়ে দেই।’ ভদ্রলোকটি বলল।পাশা মনে মনে অনেক খুশি হলো। ভদ্রলোককে বলল, ‘ভাই আন্নে একখান ফেরেস্তা।’ভদ্রলোক মুচকি হাসি দিলো।‘এই যে, এটি হলো বাস স্টেশন। দাঁড়ান, আপনাকে একটি টিকিট কিনে দেই।’ বলে ভদ্রলোকটি পাশার জন্য নিজের অর্থ ব্যয় করে একটি টিকিট কিনে দেয়।কিছুক্ষণ পর বাস এলে পাশাকে বাসের ভেতর সিট নম্বর অনুযায়ী বসিয়ে দেয়। পাশাকে ভদ্রলোক তার ফোন নম্বর দেয়।‘এটা আমার ফোন নম্বর। কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিয়েন। আর নিউইয়র্কে ঠিকমত পৌঁছে একটা কল দিবেন।’ ভদ্রলোকটি বলল।‘ঠিক আছে ভাই। আন্নের এই উপকার আঁই কোনোদিন ভুলতাম নয়।’ পাশা ভদ্রলোককে বলল।কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিলো। এর আগেই পাশা ভদ্রলোকের কাছে বিদায় চেয়ে নেয়। ভদ্রলোককে তার সাহায্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ দেয়।
তখন ভোর ছয়টা বাজে। পাশার বাস নিউইয়র্ক শহরের পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে এসে পৌঁছে। সারাটি পথ পাশা শিশুর মত বাসে ঘুমিয়ে কাটায়। এমন ঘুম মনে হয়ে পাশা জীবনেও ঘুমায়নি।
বাস থেকে নামার পর ম্যানহাটনের সৌন্দর্য দেখে প্রায় বাকরুদ্ধ। ম্যানহাটনে মানুষের সুশৃঙ্খল বন্যা, হলুদ রঙের টেক্সিক্যাবগুলোর বিরামহীন ছোটাছুটি, পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির আওয়াজ ইত্যাদি পাশা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে। আর মনে মনে বলল, ‘এই আমার স্বপ্নের আমেরিকা! আজ আমার জীবন সত্যিই ধন্য।’
পাশা টাইমস স্কয়ারের আশেপাশে হাঁটছে। আর নানা রঙের বাতি আর বিলবোর্ড দেখে সে অভিভূত। ‘টাইমস স্কয়ারে যেন পৃথিবীর সব জাতের মানুষের মেলা বসছে।’ পাশা ভাবল। পাশা এখন ক্লান্তিহীন। তার রক্তে যেন বইছে নয়া উদ্দাম। মাঝে মাঝে ম্যানহাটনের বিশাল বিশাল দালানের দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন পাশা ম্যানহাটন ঘুরে দেখে। রাস্তার পাশে একটি দোকান থেকে দুপুর বেলায় সে কিছু খেয়ে নেয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। পাশা চিন্তা করে, সে এখন যাবে কোথায়? নিউইয়র্কে তার পরিচিত কেউ নেই। ‘এখন কোন বাঙালির সাথে দেখা হলে ভালো হয়।’ পাশা ভাবল। হাঁটতে হাঁটতে পাশা ম্যানহাটনের পেন স্টেশনের সামনে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর সে দেখে একজন বাঙালি ইয়োলো ক্যাবচালক তার টেক্সি থেকে বেরিয়ে একটি সিগারেট খাচ্ছে। পাশা তার কাছে গেল।‘ভাই, আপনি কি বাঙালি?’ পাশা বলল।‘হুম, কিছু লাগবে আপনার?’ টেক্সি চালক বলল।টেক্সি চালকের বাংলাদেশের বাড়ি ঢাকা শহরে। তার নাম রতন। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। পাশা রতনকে তার সব কাহিনি খুলে বলে। রতন পাশাকে বলল, ‘আমার আজকের ডিউটি প্রায় শেষ। আমি কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে থাকি। সেখানে আমার নিজস্ব বাড়ি আছে। বাড়িতে আমি একলা থাকি। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সাথে কয়দিন থাকতে পারেন।’পাশা সাথে সাথে রাজী হয়ে গেল। রতন সিগারেটটি শেষ করে পাশাকে সাথে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
রতনের দুইটি তিনতলা বাড়ি আছে। দুই বাড়িতে মোট চার পরিবার ভাড়া নিয়ে থাকে। পাশা প্রথমে রতনের বাড়ি দুটি দেখাশোনা করত। কোন কিছুর মেরামতের প্রয়োজন পড়লে তা পাশা করত। ভাড়া নিয়ে রতনকে দিত। রতন পাশাকে অনেক বিশ্বাস করত। তাই খুশি হয়ে রতন পাশাকে তার বাড়ির একটি রুমে বিনা পয়সায় থাকতে দেয়। আর মাসে মাসে কিছু ডলারও দিত। এভাবে প্রায় পাঁচ বছর চলে যায়। রতন এবং তার আইনজীবী বন্ধুর সহায়তায় পাশা আমেরিকায় থাকার বৈধতা পেল। পাশার এখন গ্রিন কার্ড আছে। এরই মধ্যে পাশা একটি বাঙালি মালিকানাধীন ইংরেজি স্কুল থেকে কথা বলার জন্য ইংরেজি শিখে নেয়। পাশা এখন মোটামুটি ভালো ইংরেজি বলতে পারে এবং শুদ্ধ বাংলা বলতে সে এখন অভ্যস্ত।
বয়সের ভারে রতনের আর টেক্সি চালাতে ইচ্ছে করে না। রতন একদিন পাশাকে বলল, ‘আর কতদিন তুই ঘরের মধ্যে থাকবি? এখন কিছু একটা কর পাশা। বিয়ে-শাদি কর। সংসার কর।’‘কিন্তু আমি কি যে করব ভেবে পাচ্ছি না। আমার কোন চাকরি করার যোগ্যতা নাই।’ পাশা বলল।‘আমার টেক্সিখানা চালা এখন থেকে। আমার আর ভালো লাগে না টেক্সি চালাতে। গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চালাচ্ছি। আর কত চালাবো বল।’ রতন বলল।‘আমার তো কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই।’ পাশা বলল।‘তুই ওসব চিন্তা করিস না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিব।’ রতন বলল।
কিছুদিন পর রতন পাশাকে একটি ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি করে দেয়। প্রায় ছয় মাস পরে পাশা তার ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়। তারপর সে রতনের ট্যাক্সিটি চালাতে শুরু করে। আয়ের কিছু অংশ রতনকে দেয় আর বাকিটা পাশা রাখে। এভাবে কয়েক বছর চলে যায়। পাশার সাথে রতনের চাচাত ভাইয়ের মেয়ে তিন্নীর বিয়ে হয়। পাশার জমানো অর্থ দিয়ে আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সে একটি বাড়ি কেনে। বাড়িতে পাশা ও তিন্নীর সুখের সংসার। এরই ফাঁকে পাশা আরেকটি চাকরি নিল। চাকরিটি হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় মাংসের ডেলিভারি দেওয়া। পাশা সপ্তাহে চারদিন ‘দিনের শিফটে’ মাংসের ট্রাক চালিয়ে নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে ডেলিভারি দেয়। আর ‘রাতের শিফটে’ সপ্তাহে পাঁচ দিন সে রতনের ট্যাক্সিখানা চালায়। এতে তার ঘরের সব খরচ বাদে কিছু অর্থ সঞ্চয় হয়। গ্রামে মায়ের জন্য পাশা নিয়মিত অর্থ পাঠায়। এভাবে আমেরিকায় পাশার প্রায় বারোটি বছর কেটে যায়।
পাশার এখন আমেরিকায় সবই আছে। নিজের ক্যাব চালায়। নিজের মাংসের ট্রাক দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে মাংসের ডেলিভারি দেয়। ঘরে সুন্দর একখানা ফুটফুটে বউ আছে। নিউইয়র্ক শহরের আনাচে-কানাচে এখন তার সব জানা। পাশার প্রতিবেশীরা পাশাকে অনেক ভালো জানে। পাশা সবার সাথে ভালোভাবে মেশে। ওদের যতটুকু সম্ভব পাশা সময় দেয়। পাশার নিউইয়র্কের বন্ধুরা পাশাকে ছাড়া কিছুই করে না। সবকিছুতে তাদের পাশাকে চাই। আর পাশাও তাদের নিরাশ করে না।
এভাবে চলে যাচ্ছে তার সংসার। কিন্তু মাঝে মাঝে পাশা বুঝতে পারে, এসব কিছুর মাঝেও কেন জানি অন্তর থেকে সে সুখী নয়। জীবনে তার যেন কিছু একটার প্রচণ্ড অভাব। কোন কিছুতে যেন তার মন ঠিকমত বসে না।
একদিন পাশা ম্যানহাটনে ‘মেসি শপিং সেন্টারে’ তিন্নীর জন্য কিছু আনতে যায়। হঠাৎ করে পাশা এক মেয়েকে শপিং সেন্টারের ভেতর শপিং করতে দেখে। মেয়েটির বয়স ২০-২১ বছরের বেশি হবে না। গায়ে তার ভেনেজুয়েলা লেখা একটি টি-শার্ট। মেয়েটির উচ্চতা ৫ ফুট ২-৪ ইঞ্চি হবে। ওজন প্রায় ৫০ কেজির মত। মাথার চুলগুলো অনেক কালো। ফর্সা তার গায়ের রং। মেয়েটিকে দেখে তার সেলিনা রদ্রিগেজের কথা মনে পড়ে। আর সাথে সাথে পাশার শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। উত্তেজনায় তার সারা শরীরের রক্ত টগবগ করছে। যেমন একটি হরিণ শাবক দেখলে বাঘের অনুভূূতি জাগে। পাশা কী করবে বুঝতে পারছে না। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, কেন সে হঠাৎ মেয়েটির জন্য এমন বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত পাশা ঠিক করে যেভাবেই হোক সে মেয়েটির কলিজা, ফুসফুস এবং লিভার খাবে।
কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? নিউইয়র্ক শহরের প্রত্যেক কোণায় কোণায় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। তার উপর নিউইয়র্ক পুলিশকে সে প্রচণ্ড ভয় পায়। লোকের মুখে পাশা শুনেছে, নিউইয়র্ক পুলিশ কর্মকর্তারা পৃথিবীর সেরা পুলিশ। এদের কাছ থেকে কেউ রেহাই পায় না।
কিন্তু পাশার কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তার এই মেয়েটিকে যে কোন মূল্যে পেতেই হবে। দূর থেকে পাশা মেয়েটির সব কর্মকাণ্ড দেখছে। মেয়েটি কিছু জামা-কাপড় কিনে শপিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেল। পাশা তার পিছু পিছু হাঁটছে। দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে, তাই মেয়েটি কিছু বুঝতে পারেনি।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি একটি ইয়োলো টেক্সি ক্যাবে ওঠে। পাশার গাড়ি সামান্য অদূরে পার্ক করা ছিল। মেয়েটির ইয়েলো ক্যাবের দিকে চোখ রেখে পাশা তাড়াতাড়ি তার গাড়ি চালু করে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে যেন ওই ক্যাবটি অদৃশ্য হয়ে যায়। পাশা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর তার গাড়ি চালাচ্ছে। অল্পের জন্য সে আরেকটি গাড়িকে ধাক্কা দিত। পাশা ওই ইয়োলো ক্যাবকে আর দেখছে না। সে হতাশ হয়। ম্যানহাটনে প্রচুর ইয়োলো ক্যাব চলাচল করে। তাই কোন এক ইয়োলো ক্যাবের পিছু পিছু নেওয়া সহজসাধ্য নয়। পাঁচ মিনিট পরে পাশা ট্রাফিক রেড সিগন্যালে দাঁড়ায়। তার বামে এক ইয়োলো ক্যাবকে দেখতে পায়। ইয়োলো ক্যাবের পেছনের সিটে সে তাকাল। পাশা দেখে মেয়েটি ক্যাবের পেছনের সিটে বসে আছে। আর সে তার মুঠোফোনে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েটিকে দেখে পাশা স্বস্তি পায়।
ইয়োলো ক্যাবের পেছনে পাশা ধীরে ধীরে দূরত্ব বজায় রেখে তার গাড়ি চালাতে থাকে। ইয়োলো ক্যাবটি ম্যানহাটন পেরিয়ে ব্রঙ্কসে যায়। তারপর ওয়েস্টচেস্টারের দিকে যেতে থাকে। পাশা মনে মনে ভাবল, ‘আর কত দূর কে জানে? প্রায় চল্লিশ মাইল ঘুরে এসেছি। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি না তো?’
অন্যদিকে পাশার স্ত্রী তিন্নী বারবার পাশাকে ফোন করছে। পাশা সবসময় তিন্নীর ফোন রিসিভ করে। কিন্তু আজ তিন্নী দশ-পনেরোটা কল দিয়েছে কিন্তু পাশা রিসিভ করেনি। তিন্নী আবারও কল দিচ্ছে। পাশা কী করবে বুঝতে পারছে না।
চলবে...
এসইউ/জেআইএম