কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন আসছে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় গরু। ফলে জেলার কোরবানির হাটগুলো ভারতীয় গরু ও মহিষে সয়লাব হয়ে গেছে। এদিকে, ভারত থেকে স্রোতের মতো গবাদি পশু আসতে থাকায় দেশের বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। ফলে ন্যায্য মূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে কৃষক ও খামারীরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর মাংসের দাম বেড়েছে কেজিতে ১শ টাকা। এ কারণে গরু, মহিষ ও ছাগলের দাম কিছুটা বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় গরু প্রতি দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু হঠাৎ করে সীমান্ত পার হয়ে অবাধে গরু আসায় দাম কমে গেছে। এতে করে কৃষক ও খামারীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। খামারী শামসুল ইসলাম, এরশাদ হোসেন, জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, কোরবানির ঈদে পশুর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এ কারণে ঈদের ৯ মাস আগে ছোট গরু বাণিজ্যিকভাবে পালন শুরু হয়। আশা একটাই ভাল দাম পাওয়ার। কিন্তু এখন সে আশা গুড়েবালি। এখন খরচ উঠবে কিনা সন্দেহ। কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার খামারী মোজাম্মেল হোসেন সাবেরী ৩০টি গরুর খামার গড়েছেন। এখন পর্যন্ত তার ব্যয় সাড়ে ৫ লাখ টাকা। তার আশা ছিল এসকল গরু ঈদে বিক্রি হবে প্রায় ৯ লাখ টাকা। কিন্তু ভারতীয় গরুর কারণে এখন বাজার মূল্য প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা। খর, ভূট্টা, গম, ধানের আটা, ঘাস, চিকিৎসা ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিদিন খরচ বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশি খামার বন্ধ হয়ে যাবে। গরু ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম, আরজু মিয়া, আসাদুল, সোবহান আলী, শাহানুর ইসলাম, নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, তারা নিয়মিত কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবাদি পশু সরবরাহ করেন। গত বছর এ সময়ে গরুর মাংসের মণ ছিল ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা। আর এখন প্রতি মণ মাংসের মূল্য ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। সে কারণেই গত বছর থেকে এবার গরু, মহিষের দাম একটু চড়া। তবে ঈদের বাজার হিসেবে তুলনামুলকভাবে দাম কম।তারা আরো বলেন, এটার প্রধান কারণ ভারত থেকে গরু আমদানি হচ্ছে প্রচুর। তবে ঈদের বাজারে ভারতীয় গরুর চেয়ে কৃষকের ঘরে পালা গরুর চাহিদা একটু বেশি। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতে প্রতি ট্রাক গরুতে অতিরিক্ত খরচ হয় ২/৩ হাজার টাকা। তারপরও পাইকারদের গরু প্রতি গড়ে লাভ হয় ১ থেকে ৩ হাজার টাকা। কুড়িগ্রাম বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল জাকির হোসেনের দফতরের প্রেস রিলিজ সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ পথে আসা এ সকল গবাদি পশু ৫শ টাকার বিনিময়ে কাস্টমস বিভাগের মাধ্যমে করিডোর করা হয়। চলতি মাসে রোববার পর্যন্ত সময়ে দই খাওয়ারচর, নারায়ণপুর, ময়দান, দিয়াডাংগা, শালঝোড়, পাখি উড়ারচর, ধলডাংগা, বাগভান্ডার, ভাওয়ালকুড়ি,শিংঝাড়, মাদারগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় এবং ধরলা ব্রিজ চেকপোষ্টের মাধ্যেমে ৮ হাজার ৯শ ৭৩টি গরু আটক করে করিডোর করা হয়। এতে রাজস্ব আয় হয় ৪৪ লাখ ৮৬ হাজার ৫ শ টাকা। এর আগের সপ্তাহে করিডোর করা হয় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার গরু। জুলাই মাসে করিডোর হয় প্রায় ২২ হাজার গরু। ঈদকে সামনে রেখে গরু আসার পরিমাণ আরো বেড়েছে। কুড়িগ্রাম কাস্টমস ইন্সপেক্টর আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা ব্রিজ পয়েন্ট ও রৌমারী পয়েন্ট দিয়ে চলতি মাসের বুধবার পর্যন্ত ৯ দিনে ৩৫ হাজার ১শ ৪৭ টি ভারতীয় গবাদি পশু করিডোর করা হয়। এতে সরকারের রাজস্ব আসে এক কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫ত টাকা।এর মধ্যে কুড়িগ্রাম পয়েন্টে করিডোর করা হয় ২৪ হাজার ৭শ গরু ও এক হাজার ১শ মহিষ। রৌমারী পয়েন্টে করিডোর করা হয় ৯ হাজার ১শ ৪৯টি গরু এবং ১শ ৯৮টি মহিষ। ভারত থেকে আসা এসকল গবাদি পশুর মূল্য কিভাবে পরিশোধ করা হয় তা তিনি জানেন না বলে জানান। কুড়িগ্রাম প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ডা. অমিতাভ চক্রবর্তী জাগো নিউজকে জানান, জেলায় মোট গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এর মধ্যে বিক্রয় উপযোগী গরু ৫৫ হাজার ৫শ টি, ছাগল ১৬ হাজার ও ভেড়া ৩ হাজার ২শ ৭৮টি। জেলায় ২৮ হাজার পরিবার গবাদি পশু লালন-পালন করে। তবে ডেইরি খামার আছে ৫শ ৭টি। জেলায় বছরে গবাদি পশুর মাংসের চাহিদা ১ লাখ ৮০ হাজার মে. টন। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ মজনু জাগো নিউজকে জানান, ভারতের সঙ্গে পশু বাণিজ্যের কোনো চুক্তি না থাকলেও প্রতিদিন অবৈধ পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে গরু আসছে অবাধে। বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন বাজারে। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি গরু আসে কোরবানি ঈদের আগে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পশু আসে নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, ভুরুঙ্গামারী, সদর ও রৌমারী সীমান্ত দিয়ে। প্রায় ৩শ কি. মি. সীমান্ত গলিয়ে এ সকল পশু আসে। কুড়িগ্রাম খাটালের তত্ত্বাবধায়ক ইবনে আকবর দুলাল জাগো নিউজকে জানান, কুড়িগ্রাম জেলার কমপক্ষে ১৫ পয়েন্ট দিয়ে গবাদি পশু আসে। কয়েক শত কিশোর ও যুবক ভারত থেকে গরু পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের মালিকের কাছে একটি গরু পার করে পৌঁছে দিতে পারলে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। এরপর এই খাটালে জড়ো হওয়া গরুর একটি তালিকা তৈরি করে তা করিডোরের জন্য পাঠানো হয়। করিডোরে গিয়ে পশু প্রতি ৫শ টাকা করে শুল্ক দিতে হয়। আর এর পুরোটাই দেখভাল করে বিজিবি ও কাস্টমস। ঈদকে সামনে রেখে বেশি রোজগারের আশায় জীবন বাজি রেখে রাখালরা ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে ঝুঁকে পড়ছেন। নাজমুল হোসেন/এসএস/আরআইপি
Advertisement