সময়ের প্রয়োজনে জামায়াতে থেকেই জামায়াত পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছেন। মতাদর্শ ও কৌশলগত পরিবর্তন, ’৭১ প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান এবং দলের অগণতান্ত্রিক ও কোটারি পদ্ধতির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চেষ্টা করেছেন কথা বলার, বোঝানোর। সম্ভব হয়নি। উল্টো দল থেকে বহিষ্কার হন মজিবুর রহমান মনজু। একসময় ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং পরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন তিনি।
Advertisement
বহিষ্কারাদেশেও দমে যাননি। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় সমন্বয়কের ভূমিকায় রয়েছেন। দলের মূলনীতি, লক্ষ্য প্রক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে জেলায় জেলায় ডায়ালগ (সংলাপ) করছেন।
আরও পড়ুন > অলির নেতৃত্বে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’
সম্প্রতি জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কাজের ধরন, অংশগ্রহণমূলক অবস্থান, ধর্ম, দেশ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে অবস্থান পরিষ্কার করেন তিনি। জামায়াতের প্রভাবে প্রভাবিত থাকবে নাকি নতুন কোনো কাঠামোয় দাঁড়াবে ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’- এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি।
Advertisement
জাগো নিউজ : জামায়াতের সংস্কার চাওয়া নাকি অন্য কারণে বহিষ্কার হলেন?
মজিবুর রহমান মনজু : আমিসহ আরও অনেকেই তিনটা ইস্যুতে জামায়াতের রিফর্ম-এর (সংস্কারসাধন) চেষ্টা করেছি। মতাদর্শ ও কৌশলগত, ৭০ বছর ধরে দলটি একই নীতিতে চলছে।
দ্বিতীয়ত, ‘৭১ প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান। জামায়াত একই সঙ্গে বলে, ’৭১-এ ভুল করেনি, আবার বাংলাদেশকে মেনে নেয়ার কথাও বলে। একসঙ্গে সাদা ও কালো; এ জায়গায় জামায়াতের অস্বচ্ছ অবস্থান। এটা শুধু আমি নই, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেক ভয়েস-ই (কণ্ঠস্বর) এখন রাইজ (উদয়) হচ্ছে।
তৃতীয়ত, দলের মধ্যে অগণতান্ত্রিক চর্চা ও কোটারি সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। এ ভয়েস জামায়াত মেনে নেয়নি। আমাকে বহিষ্কার করা হয়। এখন আমি জামায়াতের কেউ নই। দলটির সংস্কারের বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্যও নেই। অনেক কিছুই জানি। কিন্তু এখন বলা ঠিক হবে না। যেহেতু আমি জামায়াতে নেই, এখন আমরা যেটা করছি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও জনগণের অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম হিসেবে ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলদেশ’ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এটা এগিয়ে নিতে চাই।
Advertisement
জাগো নিউজ : ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। জামায়াতি মতাদর্শ জেনেই দলটিতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে কেন জামায়াতের সংস্কারের প্রয়োজন মনে করলেন?
মজিবুর রহমান মনজু : বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। কিন্তু এখানে তো মাল্টি রিলিজিয়ন (বহু ধর্ম) মানুষের বসবাস। যখনই আপনি ধর্মের বিষয় সামনে আনবেন তখনই বিভাজন তৈরি হবে। পৃথিবীতে অনেক দেশেই জামায়াতের আদলে ইসলামী দল আছে। তবে তাদের মধ্যে ধর্মের চেয়ে একটি পলিটিক্যাল স্ট্রাকচার-ই (রাজনৈতিক কাঠামো) বেশি প্রকাশ্য। তুরস্কে হয়েছে, মিসর ও মরক্কোতেও তা-ই দেখা যায়।
আরও পড়ুন > ৭১ আর ১৯ এর জামায়াত এক নয় : অলি
কৌশলগত দিক থেকে জামায়াত ক্যাডারভিত্তিক। কেউ জামায়াতে আসলেই ঢুকতে পারে না। পর্যায়ক্রমে উপরে উঠতে হয়। অন্য কোনো দলের শীর্ষ পদের নেতা যদি জামায়াতে আসেন তাহলে তিনিও পদ পাবেন না। কর্মী থেকে শুরু করে ওপরে আসতে হবে তাকে। এটা সুসংগঠিত দলের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু সুসংগঠিত মানে জনপ্রিয় নয়। জামায়াত কিন্তু জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। কৌশলগত দিক থেকে এটা খারাপ। জামায়াতের অনেকেই এটা মানেন কিন্তু পারছেন না। কিছু মানুষের ইন্টারেস্ট (স্বার্থ) ভাঙা সম্ভব হয়নি। স্বার্থগত কারণে জামায়াতে আমাদের পরামর্শগুলো অগ্রহণীয়ই থেকে গেছে।
আমরা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করি। যেখানে সব ধর্মের মানুষ নিরাপদ ও জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। এখানে জামায়াতে ইসলামির চিন্তার ঘাটতি রয়েছে। বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হয়েছি। বহিষ্কৃত হয়েছি।
জাগো নিউজ : মতনৈক্যের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছেন। আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও জামায়াত যে লক্ষ্যে কাজ করে, একই লক্ষ্যে কাজ করে এমন আরও ইসলামিক দলও দেশে আছে। সেসব দলে যোগ না দিয়ে ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ দল গঠনের পরিকল্পনা কেন?
মজিবুর রহমান মনজু : আমরা জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা বলছি। আমরা ধর্ম ও দেশ নিয়ে কোনো বিবাদে যেতে চাই না। ধর্ম ধর্মের জায়াগায় থাকবে। দেশ দেশের জায়গায় থাকবে। আমাদের কাজ হবে মানুষ নিয়ে।
মানুষের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা ও সমস্যার সমাধানে ভয়েস-ই (কণ্ঠস্বর) আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য হবে। যে কারণে আমি অন্য কোনো ইসলামী দলে না গিয়ে নতুন দল গঠন করেছি। জামায়াত থেকে বহিষ্কারের আগে থেকেই নতুন কিছু করার প্রক্রিয়াটা শুরু করেছিলাম। শুরুতে চেয়েছিলাম জামায়াতে থেকেই। জামায়াত তা চায়নি। বের করে দিয়েছে। এখন আমি মুক্ত ও স্বাধীনভাবে নতুন দল গঠনের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ গঠন করেছি।
আরও পড়ুন > নতুন রাজনৈতিক মঞ্চের ঘোষণা জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের
জাগো নিউজ : প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, জেলায় জেলায় ডায়ালগ (সংলাপ) করছেন। সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
মজিবুর রহমান মনজু : আমরা যে আইডিয়াটা (ধারণা) নিয়ে কাজ করছি, তা মানুষের মধ্যে প্রচুর ধাক্কা বা সাড়া ফেলেছে। এটা বিএনপি বা জামায়াতপন্থীদের মধ্যে প্রভাব বেশি ফেলেছে। তবে হঠাৎ করে সবাই তো স্টাবলিস্টমেন্ট (প্রতিষ্ঠা) ছেড়ে দলে দলে এ প্লাটফর্মে আসবেন না। আমরাও ‘আস্তে চলো’ নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন জেলায় বা অঞ্চলে ডায়ালগ করছি। আমরা নিজেরা কোথাও যাচ্ছি না। যেখান থেকে সাড়া আসছে আমরা সেখানেই ছুটে যাচ্ছি। ডায়ালগ করছি। আমাদের কথা নয়, আমরা তাদের কথা শুনছি। আমরা আগে পলিটিক্যাল ফিলোসপিটা (রাজনৈতিক মতাদর্শ) দাঁড় করাচ্ছি।
‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’-এ আমরা সবার আগে গুরুত্ব দেব ইয়াংদের (যুবক)। ট্রাডিশনাল (চিরাচরিত) নয়, মিছিল-মিটিং নয়, আমরা নিউ পলিটিক্স করব। আমরা নিউ ফর্ম অব পলিটিক্স (রাজনীতির নতুন মেরুকরণ) করছি। আসলে অন্য দলের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা কী হবে, সেজন্যই ডায়ালগ (সংলাপ) করছি। যখন আলোচনা করছি তখন অনেকেই খুব সিরিয়াসলি পরামর্শ দিচ্ছেন, আইডিয়া দিচ্ছেন। এতে আমাদের ফরমেশন (সৃজন) হয়ে যাচ্ছে, রিক্রুটমেন্টও (সদস্য সংগ্রহ) হয়ে যাচ্ছে। যারা সিরিয়াসলি ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’-কে চাচ্ছেন তাদের সঙ্গে আমাদের কানেক্টিভিটি (সংযোগ) তৈরি হচ্ছে। ৪০-৫০টি জেলায় আমাদের যোগাযোগ শক্ত হলে পার্টিটাকে একটা ফরমেটে নিয়ে আসব।
জাগো নিউজ : ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’-কে অনেকেই জামায়াতের কৌশলী মঞ্চ/অবস্থান বলছেন। জামায়াতকে মাইনাস করে নতুন ও বিকল্প এ প্লাটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে। আপনার মন্তব্য কী?
মজিবুর রহমান মনজু : আমাদের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ আনা হচ্ছে। প্রথমত, জামায়াতের বিকল্প প্লাটফর্ম; দ্বিতীয়ত, সরকারের জামায়াত ভাঙার কৌশলের প্লাটফর্ম এবং তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট বিকল্প মঞ্চ।
আরও পড়ুন > অলির উদ্যোগকে স্বাগত ফখরুলের
আমাকে তো জামায়াত থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এটা জামায়াতি প্রজেক্ট (প্রকল্প) হলে তো সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা বসে থাকত না। সরকারি প্রজেক্ট হলে তো জামায়াতের সমালোচনা মোকাবিলায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট হওয়ার সুযোগ নেই। আমি তো হঠাৎ করে এটা করিনি। গত ৮-১০ বছর ধরে পরিবর্তন চেয়ে জামায়াত রিফর্মের (সংস্কার) প্রক্রিয়ায় ছিলাম।
আসলে এসবই ব্লেইম গেম (দোষারোপের খেলা)। এ গেম সবসময় ছিল, থাকবে। এসব ট্রাডিশনাল (চিরাচরিত) ব্লেইম গেম হিসেবেই দেখছি। সত্যিকার অর্থে, আমরা চাই কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা। যেখানে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবেন সবাই। কেউ কারও শত্রু হবে না। রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে জনগণের কাছে। কারও পৈতৃক কিংবা দলীয় সম্পত্তির চিন্তার খোরাক হবে না।
জেইউ/এমএআর/জেআইএম