বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগেই ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানটা ফিরে পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এরপরই বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে বাংলাদেশ দলের কোচ স্টিভ রোডস উচ্চসিত গলায় এ বিষয়টার প্রশংসা করেছিলেন। আশা প্রকাশ করেন, ‘সাকিব যে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এবার সেটা প্রমাণের সময় এসেছে।’
Advertisement
বিশ্বকাপের শুরুর দিকে বাংলাদেশের একটি ম্যাচে ইংলিশ ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস খুব অবাক হয়েই বলেছিলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই সাকিবকে র্যাংকিংয়ের উপরে দেখে হতবাক হয়ে যান।’ কেন? এর কারণ কি তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে না পারা? অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসেবে অসংখ্য সব রেকর্ডের মালিক সাকিব।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে কোচ স্টিভ রোডস যে কথা বলেছিলেন, সেটা অনুধাবন করেই কি না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এবারের আসরটি শুরু করেছেন বিশ্বমঞ্চে নিজেকে সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ করার। এবং এখনও পর্যন্ত সত্যিকারার্থেই একজন নিখুঁত এবং খাঁটি অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ করেছেন সাকিব আল হাসান।
এবারের বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রাণ ভোমরা সাকিব আল হাসান। টাইগারদের হয়ে খেলা সবগুলো ম্যাচেই ব্যাট-বল দুই বিভাগে সমান অবদান রেখেছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
Advertisement
এই আসরে ছয় ম্যাচে ব্যাট হাতে ৪৭৬ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তিন নম্বরে অবস্থান করছেন সাকিব এবং একই সঙ্গে বল হাতে ১০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। আবার দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে এক ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ রান ও পাঁচ উইকেট নেওয়ার নজিরও গড়েছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
মার্ক নিকোলাস যে মন্তব্য করেছেন, সাকিবকে নিয়ে তা শুনে কিছুটা অবাকই হয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোর লেখক জেরড কিমবার। তার মতে, সাকিবের মতো নিখুঁত এবং সত্যিকারের একজন অলরাউন্ডার খুঁজে পাওয়া যে কোনো দলের জন্যই মুশকিল ব্যপার।
তাই বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিবের মতো অলরাউন্ডার কেন বেশি নেই- এ নিয়ে ক্রিকইনফোতে একটি নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণও লিখে ফেলেছেন তিনি। শিরোনামও দিয়েছেন, ‘কেন ওয়ানডে ক্রিকেটে সাকিবের মত সত্যিকার আর কোনো অলরাউন্ডার নেই? (Why aren't there more true allrounders like Shakib in ODIs?)।
জেরর্ড কিম্বার লিখেছেন, সাকিবের ক্যারিয়াররে বেশিরভাগ সময়ই বাংলাদেশের জয়ের ধারাবাহিকতার কোন অস্তিত্ব ছিল না। যদিও দুর্বল দলকে হারাতে পারতো। তার অর্জন সবসময়ই অন্য দেশগুলোর মিডিয়ায় নিচুভাবে দেখানো হয়েছে। কারণ, বিদেশি মিডিয়া কিংবা বোদ্ধাদের ধারণা, উইকেটের সাহায্য ছাড়া সে খুব একটা ভালো স্পিনার নয়।
Advertisement
অথচ, বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে তার বোলিং দক্ষতা ক্রিকেটের উপর্যপুরি একটা অংশ। সে বোলিং নিয়ে রহস্যজনক বা আলাদা কিছু করার বদলে সবসময়ই ভালো স্পিন বল করার প্রতিভা নিয়ে কাজ করে গেছে। সাকিবের কারণেই বাংলাদেশ সবসময় অতিরিক্ত একজন বোলার কিংবা একজন ব্যাটসম্যান দলের ঢুকানোর সুযোগ পেয়েছে।
প্রায় লম্বা সময় ধরেই সাকিব অসাধারণভাবে খেলে চলেছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্ব ক্রিকেটে তিনিই একমাত্র অলরাউন্ডার যিনি ম্যাচ প্রতি সবচেয়ে বেশি বল (৮৬.৩) খেলেছেন (ব্যাটিং-বোলিং)। ম্যাচ প্রতি ৮০টি ডেলিভারি খেলে তার ঠিক পরেই অবস্থান করছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস।
ওয়ানডে ক্রিকেটে সাকিব একজন মাঝারি মানের ব্যাটসম্যান এবং বোলার। তার অভিষেক হওয়ার পর থেকে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন তিনি। এবং সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ১৩ নম্বরে অবস্থান করছেন। সাকিব হয়তোবা সেরা খেলোয়াড় না হতে পারেন; কিন্তু তার ব্যাটিং ও বোলিং দক্ষতা যে কোনো দলের জন্যই কার্যকরী। সুতরাং, সাকিবের মত একজন নিখুঁত অলরাউন্ডার খুঁজে বের করুন!
যে কোন দলই একজন অলরাউন্ডারকে সাত নম্বরে ব্যাটিং করাতে এবং পঞ্চম বোলার হিসেবে দলে নিতে চায়। যেমন ধরুন, ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস কিংবা মঈন আলির কথা। তারা সবসময়ই দলের হয়ে পঞ্চম ও ৬ষ্ঠ নম্বরে বল করে থাকেন। এবং মঈন ব্যাটিংও করেন সাত নম্বরের দিকে। যখন আপনি এতো নিচে খেলেন, তার মানে আপনার হাত খুলে খেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই; কিন্তু তাতে সত্যিকারের অলরাউন্ডার হওয়াটা কঠিন।
একজন সত্যিকারের অলরাউন্ডারের মানে হলো, যে আপনাকে ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই সমান সার্ভিস দিতে পারবে। এ বিশ্বকাপে এরকম খেলোয়াড় মাত্র দু’জনই আছেন। তারা হলেন, মোহাম্মদ নবি এবং সাকিব আল হাসান। কোনো দলেই তাদের মতো আর কেউ নেই।
যদিও প্রায় সব দলেই অনেক অলরাউন্ডার আছে; কিন্তু তারা কোনো না কোনোভাবে একটা বিভাগ থেকে পিছিয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়, ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, নিউজিল্যান্ডের জিমি নিশাম কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিস মরিসের কথা।
তাদের দেখে মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়ে অলরাউন্ডারের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে, ইংল্যান্ড দলে সবচেয়ে বেশি। সাকিব থেকে শুরু করে ফিঞ্চের মতো স্লো বল করা পর্যন্ত ৬০ থেকে ৬৫ জন খেলোয়াড় আছেন, যারা নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন; কিন্তু তাদের মধ্য থেকে সাকিবের মতো ক’জন সফল হয়েছেন? সেটা খুজে পাওয়া দুষ্কর।
ওয়ানডে ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত অন্তত ২০টি ম্যাচে খেলেছেন, এমন খেলোয়াড় আছেন ১০৩৩ জন। তাদের মধ্যে ৩১৩ জন খেলোয়াড়ই ব্যাটিং এবং বোলিং করার সক্ষমতা রাখেন। তার মানে ওয়ানডে ক্রিকেটে শতকরা ৩৮ ভাগ ক্রিকেটারই হচ্ছেন অলরাউন্ডার।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সময়ে কি আসলেই আগের চেয়ে বেশি অলরাউন্ডার খেলছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘না’ বাচক শব্দটাই এসেছে। কেননা ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত অন্তত ২০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন এমন খেলোয়াড় ১৯৪ জন। অথচ, এদের মধ্যেও শতকরা ৩৮ ভাগ ক্রিকেটার অলরাউন্ডার।
সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন! ২০৪ ম্যাচ খেলে রান করেছেন ৬১৯৩। রান নেয়রা গড় ৩৭.৫৩। উইকেট নিয়েছেন ২৫৯টি। গড় ২৯.৯৫। সাকিবের অভিষেকের পর থেকে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল ১২জন ব্যাটসম্যান। এই ১২ ব্যাটসম্যান (যারা বোলিং করতে পারেন) সবাই মিলে উইকেট নিয়েচেন মোট ৯৬টি।
এই সময়ের মধ্যে সাকিবের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন কেবল একজন বোলার। অথ্যাৎ, ব্যাটিং এবং বোলিংয়ে তুলনামূলক একটা চিত্র দাঁড় করালে সাকিব অন্যদের চেয়ে কতটা এগিয়ে, সেটা কল্পাতেও হয়তো আসবে না কারও। দীর্ঘ সময় সাকিবের অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকার মূল রহস্যই আসলে এখানে।
ওয়ানডে ক্রিকেট কখনোই অলরাউন্ডার চাওয়ার আকাঙখা কিংবা তাদেরকে বেশি অর্থ দিয়ে পুরস্কার দিতে চায়নি; কিন্তু তারপরও সংখ্যার কোনো পরিবর্তন নেই। বেশিরভাগ দলই স্বপ্ন সাকিবের মতো খেলোয়াড়কে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে যা আছে তা নিয়েই খেলতে হয়। সাকিবের মত একজন খাঁটি এবং নিখুঁত অলরাউন্ডার উপহার দিতে পারেনি।
এএইচএস/এমএস