দালালদের দৌরাত্ম আর নানা জটিলতায় নিবন্ধন করেও বৈধতা পায়নি সিংহভাগ বাংলাদেশি। প্রতারণার শিকার হওয়া এসব বাংলাদেশিরা একদিকে যেমন আটক হওয়ার আশংকায় দিন পার করছে তেমনি স্বপ্নও দেখছিল বৈধ হওয়ার।
Advertisement
তাদের দাবি ছিল- যারা নিবন্ধন করেছিল অন্তত তাদেরকে বৈধতা দেয়ার। এ বিষয়ে সব দেশের কূটনৈতিকরা সে দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করেছে, সুপারিশও করা হয়েছে বৈধতা দিতে। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার প্রতারণার শিকার বিদেশি কর্মীদের একটি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আশার আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
বরং ধরপাকড় অভিযান চলছেই। নির্মাণ শ্রমিক মোহাম্মদ মিলন হোসেন বলছিলেন, দেশের প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখা অবৈধ বাংলাদেশিরা আটক হয়ে দেশে ফিরলে একদিকে তাদের পরিবার যেমন ক্ষতির মুখে পড়বে তেমনি প্রবাসী আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়কে। তাই, দেশটিতে থাকা প্রবাসীদের আহ্বান এই সংকট সময়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অবৈধদের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য ইতিবাচক থাকলেও এ সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশ হতে মালয়েশিয়া পর্যন্ত রয়েছে দালাল ও মানবপাচারকারী চক্রের নানান অপতৎপরতা। যদিও বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দালাল ও মানবপাচার রোধে রয়েছে কঠোর আইন।
Advertisement
আর এ আইনকে বাস্তবায়নে এবং কর্মী ব্যবস্থাপনায় স্ট্যান্ডার্ড অর্জনে কাজ করে চলেছে দুই দেশের সরকার। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীর মোট পরিসংখানের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশিরা। এর আগে ২০১৫ সালের এক হিসাব বলছে বিদেশি কর্মীর এই পরিসংখ্যানে ১৩ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল বাংলাদেশি কর্মীরা।
এত গেল বৈধদের পরিসংখ্যান। অবৈধ বাংলাদেশিদের সংখ্যা কারো জানা না থাকলেও, অবৈধদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এসব অবৈধ বাংলাদেশিরা বৈধ হতে চেয়েও প্রতারিত হয়েছে। দেশটির নিয়োগকর্তাদের অবৈধ বিদেশি কর্মীদের উৎপাদন, নির্মাণ, সেবা এবং কৃষিসহ মোট পাঁচটি খাতে বৈধ করে নেয়ার সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়ার সরকার।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গেল বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় আড়াই বছর ছিল সে সুযোগ। সে সময় প্রায় ৬ লাখ ৪৫ হাজার অবৈধ বিদেশি নিবন্ধন করে, এতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ অবৈধরা বৈধতা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
এদিকে মাসের পর মাস ধরে অবৈধতার অভিশাপ নিয়ে গ্রেফতার আতংকে দিন পার করছে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। দু’দেশের সরকারের আন্তরিকতায় সহজ শর্তে বৈধতা পাবে এমনটাই প্রত্যাশায় প্রহর গুনলেও মালয়েশিয়া সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে। অবৈধ বিদেশিদের আর বৈধতা দেবে না। নিজ নিজ দেশে ফিরতেই হবে তাদের।'
Advertisement
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কাজী সালাহ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত কোতারায়া এলাকায় প্রতিদিন বাংলাদেশি শ্রমিকদের ব্যস্ততা থাকতো। তবে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইমিগ্রেশন বিভাগের ধড়পাকড়ের পর থেকে বাংলাদেশি ছাড়াও অন্যান্য বিদেশি শ্রমিকরা আড়ালে চলে গেছেন। শুধু অবৈধরাই নয়, বৈধ অনেক শ্রমিকেই এখন হয়রানির ভয়ে আত্মগোপন করছেন। এ ছাড়াও কংসীর মতো অভিবাসীপ্রবণ এলাকায় এখন খুব কম সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক দেখা যাচ্ছে।’
কোটা দামাসারা থাকেন বাংলাদেশি শ্রমিক নূরু। তিনি জানিয়েছেন, তার সঙ্গে কাজ করা অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক সঠিক কাগজপত্রের অভাবে বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছেন। এমনকি তাদের ফ্যাক্টরিতে গত কয়েকদিন আগে ইমিগ্রেশন বিভাগ অভিযান চালিয়েছিল। তবে সবারই সঠিক কাগজপত্র থাকায় কাউকে আটক করা হয়নি। কিন্তু অনেক শ্রমিক ভয় পেয়ে পরের দিন আত্মগোপনে চলে যান।
ইপু পেরাকে কর্মরত শ্রমিক হারুন মিয়া বলেন, ‘এই এলাকায় প্রচুর নির্মাণ শ্রমিক বাস করতেন। যাদের প্রায় সবার সঠিক ডকুমেন্টস ছিল। কিন্তু ভয়ে অনেকেই এই স্থান ছেড়ে কংসীতে চলে গেছেন। বিশেষ করে যে এলাকাগুলোতে ইমিগ্রেশন বিভাগের অভিযান হওয়ার সম্ভাবনা কম সেখানে পালিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা।’
এদিকে জাল ভিসা তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত এক বাংলাদেশিকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। আরও দুইজনকে গ্রেফতার করতে অভিযান শুরু করেছে। ২৪ জুন রাজধানী কুয়ালালামপুর জালান চৌকিত এলাকার একটি কনডোমনিয়ামে অভিযান চালিয়ে এক বাংলাদেশিকে আটক করে। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৪০টি বাংলাদেশি পাসপোর্টের ফটোকপি, ২টি কম্পিউটার, ভিসা তৈরির তিনটি মেশিন ও চারটি জাল ভিসা স্টিকার।
কুয়ালালামপুর ইমিগ্রেশন প্রধান হামিদি এডাম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, আটক বাংলাদেশি দুই বছর ধরে বিদেশি অভিবাসী অধ্যুষিত লেমবাহ কিলাং লামা ও বুকিত বিংতান এলাকায় অবৈধ কর্মকান্ডের বিস্তার করে আসছিল। আটক বাংলাদেশি বিভিন্ন শ্রমিকদের জন্য জাল ভিসা, সিআইডি কার্ড ও আইকার্ড তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল। আর এসব জাল কাগজপত্র তৈরিতে জনপ্রতি ২৫০০ থেকে ১৬ হাজার টাকা নিত ওই বাংলাদেশি। এভাবে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা আয় করত।
তবে তদন্তের স্বার্থে আটক বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করেনি ইমিগ্রেশন পুলিশ। আটক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন আইনের ৫৫ডি, ১৯৫৯/৬৩ ২০০২ সেকশন ৫৬ (১এ) সি, ১২(১) এফ, পাসপোর্ট আইনের ১৯৬৬ সেকশন ১২ (১) ধারায় জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরে কয়েকটি স্থানে অভিবাসন বিভাগের অভিযানে জাল পাসপোর্ট ভিসা তৈরির অভিযোগে আরও ১৫ জন বাংলাদেশিদের আটক করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের সুনাম থাকায় কিছু অসাধু চক্র নানান অবৈধ পথ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ন মানবপাচার করছে ফলে সহজেই বাড়ছে অবৈধ লোকের সংখ্যা। মালয়েশিয়ার সরকার দফায় দফায় বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও অবৈধ বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এদিকে স্থগিত কর্মী নিয়োগ পুনরায় উন্মুক্ত করতে এবং অবৈধদের বৈধতা ও প্রতারণার শিকার কর্মীদের সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও নামধারী কতিপয় দালাল চক্র আগাম তৎপরতা ও ভুল বার্তা দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে ফেলেছে জটিলতায়। কেননা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাহাথির সরকারের স্পষ্ট ঘোষণা এবং বাংলাদেশ সরকারের স্পষ্ট অবস্থান থাকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের কিছু এজেন্টদের তৎপরতা কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে দুটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় নির্দিষ্ট হওয়া বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মালয়েশিয়া সরকার সতর্কতা অবলম্বন করছে।
গত ২৮ জুন ক্যামেরুন হাইল্যান্ডে কৃষক সংগঠনের নেতাদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মানবসম্পদ মন্ত্রী কুলাসেগারান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনার বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে (এমওইউ) চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, যদিও আমরা এমওইউতে স্বাক্ষর করার ইচ্ছা রাখি তবে প্রথমে কিছু পরামর্শ এবং কিছু বিষয় সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘যেসব বিষয়গুলো সমাধান করা দরকার তা হলো এখানে বিদেশি শ্রমিকদের বেতন ও সুরক্ষা এবং আমরা জানতে চাই যে কোনো পদক্ষেপ (বাংলাদেশ সরকার) দেশে অবৈধ বিদেশি কর্মীদের ফিরিয়ে নিতে হবে।’
এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, প্রবাসীদের সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। প্রবাসে একজন কর্মী যে কারণেই অবৈধ হোক না কেনো, তিনি যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক তার দায়িত্ব সরকার নেবে এবং নিচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
বর্তমান সরকার প্রবাসীদের বিষয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে উল্লেখ করে ইমরান আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বের যেখানেই প্রবাসীদের সমস্যা হোক না কেন, দূতাবাসগুলো তার সমাধানে বদ্ধপরিকর।’
প্রতিমন্ত্রী কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেনো কোম্পানি পরিবর্তন না করেন। অনেক কর্মী আছে, যারা এক কোম্পানির ভিসায় গিয়ে বেশি বেতনের আশায় কোম্পানি পরিবর্তন করেন। এটা করলে তারা অবৈধ হয়ে যাবেন। তখন তারা নানা সমস্যায় পরেন। তাই প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সে দেশের আইন কানুন ভালোভাবে জেনে, সেগুলো মেনে চলার আহ্বান জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ পক্ষে এমন কিছু কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে তা পক্ষান্তরে মালয়েশিয়ার জন্য বিব্রতকর। অপরদিকে প্রতারণার ফাঁদ পাতানো বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। আর ওই সব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, উইচ্যাটসহ ভিন্ন অবলম্বন। প্রবাসীকর্মী হতে সরকারের আইনগত সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে এবং এ সম্পকির্ত আইনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নীরব থাকে।
শক্তিশালী একটি ভিজিলেন্স টিম এবং তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদানের জন্য ১১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হলেও প্রতারকদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি সবক্ষেত্রে অভিবাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে বাংলাদেশ বেশি উপকৃত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এমআরএম/এমএস