দেশজুড়ে

‘ডেড স্টপে’ বন্দি আখাউড়া-সিলেট রেলপথ

খোদ রেল বিভাগের মতে সিলেট-আখাউড়া রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩টি সেতু মরণফাঁদ। যদিও সচেতন মহলের মতে এই সেকশনের সবগুলা সেতুই ঝুঁকিপূর্ণ৷ রেলওয়ের তালিকায় থাকা এই ১৩টি সেতুর ওপর ট্রেন পারাপারে ‘ডেড স্টপ’ (সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, এরপর পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে) ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ‘ডেড স্টপ’ এর আওতাধীন।

Advertisement

এই রুটে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় ট্রেন। তবুও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। রেললাইন ও সেতু সংস্কারে নেয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ।

রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও- শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতু এবং মনতোলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। সেতু সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এগুলো সংস্কার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্য মতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়ীকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন গড়ে ১২বার চলাচল করে। এসব যাত্রায় প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশন নিয়ে সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম পথে ভ্রমণ করেন। রেল পথে যারা ভ্রমণ করেন তাদের বেশির ভাগই রেলকে বেছে নেন নিরাপদ যাত্রার মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু বারবার যান্ত্রিক ত্রুটি ও দুর্ঘটনার কারণে এই রেলপথে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের মনু স্টেশনের পাশের খরস্রোতা মনু নদের উপর মনু ব্রিজের দূরাবস্থা নিয়ে ২০১৭ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ হয়৷ মনু বিজ্রের স্লিপারের নাট খুলে যাওয়া এবং কাঠের বদলে বাঁশ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে তখন রেলসেতুটি মেরামত করে কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু মনু সেতুটি এখনও সেই অবস্থায়ই আছে এবং রেলওয়ের ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর তালিকায়ও রয়েছে এটি। কুলাউড়ায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার মতো কোনো দুর্ঘটনা মনু ব্রিজে ঘটলে প্রাণহানী ঘটবে শতাধিক।

শ্রীমঙ্গল-সাতগাঁও স্টেশনের মাঝামাঝি এলাকায় ভইষমারা রেল সেতুটিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দীর্ঘদিন ধরে৷ ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল পাহাড়ি ঢলে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর থেকেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে৷

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার ৫৬ নম্বর সেতুর নিচে গত বছরের ২৯ মার্চ বৃষ্টির পর মাটি সরে যায়। এতে রেল যোগাযোগ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে ৷ তারপর থেকে ওই সেতুটিতে ডেড স্টপ দিয়েই চালানো হচ্ছে ট্রেন৷

এসব ব্যাপারে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন ম্যানেজার সজিব কুমার মালাকার জানান, এই সেকশনের বেশিরভাগ সেতুই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এরমধ্যে মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতুতে ‘ডেড স্টপ’ জারি করা হয়েছে।

Advertisement

এই রুটে রেল দুর্ঘটনা নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার এই রুটে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ট্রেন। যান্ত্রিক ত্রুটি, বগি লাইনচ্যুত হওয়া, বগি থেকে ইঞ্জিন খুলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেসের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং একটি বগি পাহাড়ি খালে ছিটকে পড়ায় প্রায় ২ শতাধিক আহত এবং ৪ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এই দুর্ঘটনার কারণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এলাকাবাসী মনে করছে দুর্বল সেতুর কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাহাড়ি এলাকায় ইঞ্জিনের দুর্বলতার কারণে ভোর রাতে দু’দফা আটকা পড়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর বিকল্প ইঞ্জিন এলে রেলগাড়িটি সচল হয়। এতে পাহাড়ি এলাকায় যাত্রীরা চরম ভীতি ও দুর্ভোগের শিকার হন।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিন বিকল হয়ে শ্রীমঙ্গলে চার ঘণ্টার মতো আটকে থাকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে পারাবত এক্সপ্রেস৷ ৫ এপ্রিল রাতে মাইজগাঁও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় শাহজালাল সারকারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি স্পেশাল ট্রেনের বগিটি লাইনচ্যুত হয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের।

১৬ মে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর এলাকায় জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়৷ এর আগে গত বছরের ২৮ মার্চ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী তেলবাহী একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে।

বারবার এই লাইনে দুর্ঘটনার খবরে আতঙ্কিত এই সেকশনে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীরা।

এসব বিষয়ে রেলমন্ত্রী নরুল ইসলাম সুজন জানান, আখাউড়া-সিলেট রেলপথ পুরাতন তাই নতুন করে তা নির্মাণ করা হবে। এজন্য ইতোমধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

এফএ/জেআইএম