লন্ডন, কার্ডিফ, এডিনবরা, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, ব্রিস্টল, টনটন, নটিংহ্যামশায়ার, লেস্টার, চেস্টারলি, নটিংহ্যাম কিংবা সাউদাম্পটন- যুক্তরাজ্যে আপনি যেখানেই যাবেন, সেখানেই দক্ষিণ এশিয়ান মানে ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানিরদের দেখা পাবেন।
Advertisement
তবে সন্দেহাতীতভাবে এখানে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী ভারতীয়। বার্মিংহাম আর ম্যানচেস্টারে যে সংখ্যাটা আরও বেশি। ট্যাক্সিতে চড়লেই কানে আসে সাম্প্রতিক হিন্দি ছায়াছবির গান। কোনো সিগনালে বাস, প্রাইভেটকার কিংবা ট্যাক্সিতে অপেক্ষায় আছেন? সেখানেও শুনবেন পাশের গাড়িতে একজন মনের আনন্দে কেউ হিন্দি গান বাজাচ্ছেন।
বার্মিংহামের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী শামিম চৌধুরী জানালেন, শুধু সংখ্যায় না, এ শহরে ভারতীয় প্রবাসী আর ভারতীয় বংশোদ্ভুতরা অনেক ভালো জীবন-যাপন করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, অফিস-আদালত সব জায়গায় ভারতীয়দের আধিক্য ও প্রাধান্য।
সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজগুলোয় প্রচুর ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীর বড় একটা অংশও এখানে ভারতীয়। এছাড়া কম্পিউটার টেকনোলোজি এবং কর্পোরেট হাউসগুলোতেও ভারতীয়দের আধিক্য। আপনি অফিস-আদালত যেখানেই যাবেন না কেন, দেখবেন বড় বড় পদে অধিস্থ ভারতীয়রা।
Advertisement
সংখ্যায় পাকিস্তানিরাও কিন্তু কম নয়। তাদের সংখ্যাটা ভারতীয়দের প্রায় কাছাকাছি। তবে শিক্ষা-দীক্ষায় ভারতীয়দের তুলনায় পিছিয়ে থাকার কারণে অফিস কিংবা কর্পোরেট হাউসগুলোতে তাদের উপস্থিতি কম। শিক্ষক, চিকিৎসক আর প্রকৌশলীর চেয়ে দোকানপাটের মালিক, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আর ট্যাক্সিচালকই বেশি।
বয়সে তরুণ হলেও মাত্র ৯-১০ বছরে ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ সুনাম কুড়ানো বাংলাদেশি শামিম চৌধুরীর কথায় পরিষ্কার হলো, এই শহরে প্রবাসী বাঙালি বংশোদ্ভুতরা সংখ্যায় তৃতীয়। এদিকে ভারতীয়দের অধিনস্ত এই বার্মিংহামের এজবাস্টনেই আগামী ২ জুলাই ভারতের বিপক্ষে এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মাঠে নামছে বাংলাদেশ। রাউন্ড রবিন লিগে এটি বাংলাদেশের ৮ নম্বর খেলা হলেও ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি মাশরাফি বাহিনীর কাছে অঘোষিত কোয়ার্টার ফাইনাল, অস্তিত্বের লড়াই। সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে এ ম্যাচ জেতা ছাড়া যে কোনো পথ নেই।
কাজেই এ ম্যাচকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অন্যরকম বাতাবরণ। বাংলাদেশের আপামর ক্রিকেট প্রেমীর চোখই এখন বার্মিংহামে। সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই ২রা জুলাই। বসে নেই বার্মিংহামের বাংলাদেশিরাও। সংখ্যায় কিছু কম হলেও উৎসাহ-উদ্দীপনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস একটুও কম নেই তাদের মধ্যে। তারাও সর্বাত্মক প্রস্ততি নিয়ে রাখছেন।
স্থানীয় বাংলাদেশিদের কাছ থেকে জানা গেল, প্রিয় জাতীয় দলের খেলা দেখতে এবং মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের মাঠে গিয়ে সমর্থন জানাতে ও উৎসাহিত করতে মুখিয়ে আছেন ব্রিটেনের বাংলাদেশি সমাজ। লন্ডন, কার্ডিফ, ব্রিস্টল, টনটন, নটিংহ্যাম আর সাউদাম্পটনের মাঠে ছিল উপচে পড়া বাঙালিদের ভিড়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ হলো, ২ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারত ম্যাচে নাকি অন্য সব শহরের চেয়ে বেশি টাইগার সমর্থকদের সমাগম হতে চলেছে বার্মিংহামে।
Advertisement
এমনকি আগামী পরশু এই শহরের এজবাস্টনে ভারত আর ইংল্যান্ডের বিগ ও হাইভোল্টেজ ম্যাচের চেয়েও বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ নিয়ে বেশি সাড়া পড়েছে। কারণ হাজার-হাজার বাংলাদেশি এজবাস্টনে প্রিয় জাতীয় দলের খেলা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তাই লন্ডন, ম্যানচেস্টার, ব্রিস্টল, কার্ডিফ, টনটনসহ বিভিন্ন শহর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঝাঁকে-ঝাঁকে বার্মিংহাম আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা অংশ পড়েছেন বেশ বিপাকে। বেশ ক'জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের অনেক বেশি মূল্য দিয়ে টিকেট কিনতে হচ্ছে। ব্যবসায়ী শামিম চৌধুরীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী এখন মানে- শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন শহর থেকে আগত এবং বার্মিংহামে যেসব বাঙালি খেলা দেখতে চাচ্ছেন তাদের গড়ে ৫০ থেকে ১০০ পাউন্ড বেশি মূল্যে টিকিট কিনতে হচ্ছে এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খবর হলো, সেই চড়া মুল্যের টিকিট কিনতে হচ্ছে ভারতীয়দের কাছ থেকে। কারণ ভারতীয়দের হাতেই ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের টিকিটের একটা বড় অংশ চলে গেছে।
তবে ঘটনাটি ভারতীয়দের সৃষ্টিকৃত অবৈধ কারসাজি হিসেবে ধরে নেবেন না! স্থানীয়দের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আইসিসির ওয়েবসাইটে টিকিট বিক্রি শুরুর মুহূর্ত থেকে ভারতীয়রা টিকিট বুক করতে শুরু করেছে। যে যার মত অনলাইন বুকিং দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে ফেলেছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানিদের মূল অংশটা আইসিসির অনলাইনে ভারতীয়দের মত চট জলদি টিকিট বুকিং না দিয়ে দেরিতে টিকিট সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। তারা ভেবেছে আস্তে-ধীরে বুকিং দেয়া যাবে। সময় তো আছেই। আর হাতে টাকা থাকলে টিকিট পাবই।
কিন্তু তার আগেই যে, ৬০ থেকে ৭০ ভাগ টিকিট ভারতীয়দের হাতে চলে যাবে এটা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। ভাবতেও পারেননি। শামিম চৌধুরী জানালেন, এই দেরিতে অনলাইন টিকিট বুকিং করতে গিয়ে দারুণ বিপদে পড়েছেন পাকিস্তানিরা। ভারতের বিপক্ষে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে পাক-ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাই মাঠে পাকিস্তানি সমর্থক ছিল খুব কম।
ভারতীয়রা আগেই সব টিকিট কিনে রাখায় পাকিস্তানিরা পরে এসে টিকিট কিনতে পারেনি। স্থানীয় বাংলাদেশিরা জানালেন আরও একটি মজার তথ্য, তা হলো ভারত পাকিস্তান ম্যাচ যে শহরে হয়েছে সেই ম্যানচেস্টারে ভারতীয় আর পাকিস্তানিরা সংখ্যায় প্রায় সমান সমান।
কিন্তু মাঠে দু'দলের দর্শক-সমর্থকের অনুপাত ছিল ৭৫ : ২৫। কারণ একটাই, পাকিস্তানি দর্শকরা ম্যাচের আগে, শেষ মুহূর্তে অনেক বেশি দাম দিয়েও টিকিট পায়নি। অনেকে তো হাতে বাড়তি অর্থ নিয়ে খেলার দিন সাত সকালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে এসেছিলেন। কিন্তু টিকিট না পেয়ে মাঠের ভিতরে ঢোকার অনুমতি মেলেনি। তাই ওল্ড ট্রাফের্ডের বাইরে পাকিস্তানি ভক্ত-সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বেশি।
এই যদি হয় অবস্থা; তবে বাংলাদেশের ভক্ত ও সমর্থকদের হালচাল কী? তাদের অবস্থা কি পাকিস্তানিদের মতো হবে? জানা গেল, বাংলাদেশিরা পাকিস্তানিদের মত অত দুলকি চালে চলেননি। তারা অনেকে আগে ভাগে টিকিট কিনে ফেলেছেন।
তবে যারা শেষ মুহূর্তে দলের খেলা দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তারা পড়েছেন খানিক সমস্যায়। এছাড়া অনেকের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব; অন্য শহর থেকে যারা বাংলাদেশের ম্যাচ দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাদের জন্য টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি কেউ-কেউ।
তাই অনলাইনে টিকিট কেটে রাখা ভারতীয়রা এখন বাংলাদেশিদের কাছে অনেক চড়া মূল্যে টিকিট বিক্রি করছেন। জানা গেছে, এই দেরিতে টিকিট সংগ্রহের কারণে অনেক বাংলাদেশিই বেশি মূল্যে ভারতীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন স্ট্যান্ডের টিকিট গড়ে ৫০ থেকে ১০০ পাউন্ড বেশি দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভিআইপি গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড আর ভিভিআইপি হসপিটালিটি বক্স বাদ দিলে বাংলাদেশের শেরে বাংলায় হাতে গোনা দুই তিনটি স্ট্যান্ড; শহীদ জুয়েল, শহীদ মোস্তাক এনক্লোজার আর ক্লাব হাউস। আর পূর্ব দিকে বিশাল সাধারণ গ্যালারি।
তবে যুক্তরাজ্যের প্রায় ভেন্যুতে অনেক বেশি স্ট্যান্ড। এজবাস্টনে সেকশন ব্রোঞ্জ, সেকশন সিলভার, সেকশন গোল্ডেন, সেকশন প্লাটিনামসহ প্রাইয়োরি ফ্যামিলি স্ট্যান্ড এবং এরিক হলিজ সেকশনের টিকি বিক্রি হচ্ছে অনেক চড়া মূল্যে।
এমনিতে সেকশন ব্রোঞ্জকে ধরা যায় বাংলাদেশের সাধারণ গ্যালারি। যার প্রকৃত প্রবেশ মূল্য ৬০ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৯০০ টাকা)। সিলভার সেকশনের টিকিটের মুল্য ৭৫ পাউন্ড (৮ হাজার ৬০০ টাকা প্রায়), গোল্ড সেকশনের অফিসিয়াল রেট ১৫০ পাউন্ড (১৭ হাজার ১৭৫ টাকা) এবং প্লাটিনাম সেকশনের প্রকৃত প্রবেশ মূল্য ২০০ পাউন্ড (প্রায় ২৩ হাজার টাকা)।
এখন এই টিকিটগুলো গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ পাউন্ড বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে অনেক প্রবাসী বাঙালিকে। কিন্তু তাতেও উৎসাহ-উদ্দীপনা এতটুকু কমেনি। দেশ মাতৃকার টানে প্রিয় জাতীয় দলকে উৎসাহ জোগাতে অত দাম দিয়েও এর মধ্যে অনেকে টিকিট কেটে ফেলেছেন। আজ-কাল ও পরশুর মধ্যে আরও অনেকে কিনবেন বলে জানা গেছে।
এআরবি/এসএএস/এমকেএইচ