আইন-আদালত

শতবর্ষী রাবেয়ার মামলার বিচারককে তলব

শতবর্ষী রাবেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে চলমান যে মামলাটি হাইকোর্ট তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন সেই মামলার কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে ঢাকার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারককে তলব করেছেন হাইকোর্ট। বুধবার (৩ জুলাই) তাকে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে। সেদিন ওই আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটরকেও (এপিপি) হাজির হতে হবে।

Advertisement

বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বুধবার (২৬ জুন) এ আদেশ দেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল। রাবেয়া খাতুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আশরাফুল আলম নোবেল। তিনিই এ তথ্য জানান।

রাবেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি গত ৩০ এপ্রিল তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ৩০ এপ্রিল এক আদেশে হাইকোর্ট ১৮ বছর আগে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায় অশীতিপর রাবেয়া খাতুনের মামলার কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। মামলার নথি তলব করে বিচার বিলম্বের ব্যাখ্যা দুই সপ্তাহের মধ্যে জানতে চান আদালত।

Advertisement

১৫ মে পরবর্তী আদেশে ২৬ জুন রাবেয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তার আইনজীবীকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া এপিপিকেও হাজির হতে বলেন। এর ধারাবাহিকতায় বুধবার রাবেয়া এবং এপিপি সাহাব উদ্দিন মিয়া আদালতে হাজির হন।

পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল বলেন, স্থগিতাদেশ থাকার পরও মামলার কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ঢাকার অতিরিক্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারককে তলব করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই আদালতের এপিপিকেও হাজির হতে হবে। এছাড়া এ মামলার অন্যতম আসামি জুলহাস মিয়া মারা গেছেন কিনা, সে বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। ৩ জুলাই এপিপিকে ফের আদালতে আসতে হবে। রাবেয়াকে আসতে হবে না। তবে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে।

‘অশীতিপর রাবেয়া, আদালতের বারান্দায় আর কত ঘুরবেন তিনি’ শীর্ষক শিরোনামে গত ২৫ এপ্রিল জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী মো. আশরাফুল আলম।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধে তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে অশীতিপর রাবেয়া খাতুনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন ২০০২ সালের ২ জুন। মামলা নম্বর ১৯৩৮/০২। এরপর তিনি গ্রেফতার হন, ছয় মাস কারাগারে থেকে জামিনও পান। পরে তাকেসহ দুই আসামি জুলহাস ও মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য ২০০৩ সালের ২৪ মার্চ শুরু হয় মামলার বিচার।

Advertisement

তেজগাঁও থানা এলাকার ৩/ক গার্ডেন রোড, কাজী আবদুল জাহিদের ঘরের দক্ষিণ পাশ থেকে গ্রেফতার করা হয় রাবেয়া খাতুনকে। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলি উদ্ধারের দাবি করে পুলিশ। ওই মামলা থেকে মুক্তি পেতে ঢাকার আদালতের বারান্দায় ১৮ বছর ধরে ঘুরছেন রাবেয়া।

মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের সমীরপুর গ্রামে জন্ম রাবেয়ার। বিয়ের পর বাবা আদর করে শ্বশুরবাড়ি যেতে দেননি। টাঙ্গাইলের বাসিন্দা স্বামী শাহজাহান সিরাজ কৃষিকাজ করতেন সে সময়। স্বাধীনতার পর দেশে কলেরা মহামারি রূপ নিলে মারা যান শাহজাহান। রেখে যান দুটি মেয়ে। বর্তমানে রাবেয়া মিরপুর কাজীপাড়ায় তার ছোট মেয়ের বাসায় থাকছেন। সেখান থেকে প্রতি তারিখে এসে আদালতে হাজিরা দেন।

ছোট মেয়ে লাইলী ও তার জামাই ২০০২ সালে থাকতেন কারওয়ানবাজার কাজীপাড়ার আন্দার ব্রিজের পাশে। ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তেজগাঁও থানার এক দারোগা ও তার ফোর্সসহ ওই এলাকায় ফেনসিডিল আসক্তদের ধরতে অভিযান চালায়। সে সময় ছাপড়ার পাশে রাবেয়ার পান-সিগারেটের টং দোকান ছিল।

রাবেয়া বলেন, ‘দারোগাকে (এসআই) ঘরে নিয়ে বসতে দেই। মোরাব্বা ও শরবত বানিয়ে খাওয়াই। এ সময় বাচ্চু নামে একজন ফরমার (পুলিশের সোর্স) ঘরে ঢুকে বলেন, নানি একটা লাঠি দেন। এই বলে ঘরের ভেতর থেকে একটা লাঠি বের করার সময় সে চিৎকার করে বলে, পাইছি, পাইছি। অস্ত্রসহ ব্যাগ দারোগার হাতে দেয় সে। এরপর দারোগা আমাকে বলে, খালা তোমাকে তেজগাঁও থানায় সাক্ষী দিতে যেতে হবে। পরে থানায় আসার পর একটা টিপসই দেই। রাতে থানায় থাকি। পরদিন কোর্টে চালান করে দেয় আমাকে। কোর্টে আনার পর বিচারক ওই দারোগাকে বলেন, এই বৃদ্ধ নারীকে নিয়ে আসেছেন কেন? একজনকে দেখলেই তাকে ধরে আনতে হবে? এরপর ছয় মাস কারাগারে থেকে জামিনে বেরিয়ে আসি। তারপর থেকে প্রতি মাসেই একবার করে হাজিরা দেই আদালতে।’

আলাপচারিতায় রাবেয়া দাবি করেন তার বয়স ১০৪। কিন্তু পুলিশের করা ২০০২ সালের মামলায় রাবেয়ার বয়স ৬০ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসাবে তার বয়স ৭৭। রাবেয়ার আইনজীবী মেহেদী হাসান পলাশ জানান, আসামির বয়স ৮০ বছরের বেশি। পুলিশ সাধারণত মামলার সময় আসামির বয়স অনেক ক্ষেত্রে কম লিখে থাকে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি রাবেয়া খাতুনকে তেজগাঁও থানা এলাকার ৩/ক গার্ডেন রোড, কাজীপাড়া আবদুল জাহিদের ঘরের দক্ষিণ পাশ থেকে পালানোর সময় একটি চটের ব্যাগসহ গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। রাবেয়ার সঙ্গে আরও দুজন আসামি জুলহাস ও মাসুদের সম্পৃক্ততা ছিল। আইনজীবী জানিয়েছেন, জুলহাস ছিল রাবেয়ার মেয়ের জামাই। তাকে ধরার জন্য পুলিশ সেদিন বাসায় গিয়েছিল। পরে জুলহাস মারা গেছে বলে জানা গেছে। মামলার অবস্থানগত কারণে রাবেয়াকে আসামি করা হয়েছে।

২০০২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবদুল আজিজ তদন্ত শেষে ১২ জনকে সাক্ষী করে রাবেয়াসহ দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অপর আসামি মাসুদের বিরুদ্ধে সঠিক নাম-ঠিকানা খুঁজে না পাওয়ায় অব্যাহতির সুপারিশ করেন। আদালতের নথিতে জুলহাস পলাতক। মামলাটিতে এ পর্যন্ত ১২ সাক্ষীর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ছয়জনকে আদালতে উপস্থাপন করেছেন।

এফএইচ/এনএফ/এএইচ/জেআইএম/এমএস