দেশজুড়ে

শাহনাজ কবীরের দেশ সেরা প্রধান শিক্ষক হওয়ার গল্প

দেশের সেরা ‘প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত হয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনায় ভাসছেন কিশোরগঞ্জ এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীর। দেশ সেরা হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন পাচ্ছেন তিনি।

Advertisement

শাহনাজ কবীরের বাবা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের প্রতি আগ্রহ থাকার কথা তার। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল শিক্ষকতার প্রতি। স্বপ্ন দেখতেন একদিন দেশের সেরা শিক্ষক হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষা পাস করতেই ১০টি স্কুল বদলাতে হয়েছে শাহনাজকে!

আগের সংবাদটি পড়ুন : তিনি দেশ সেরা প্রধান শিক্ষক

জীবন চলার পথে নানা চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে তাকে। লড়াই করতে হয়েছে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে। তবে কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তিনি ছিলেন অবিচল। শুধু নিজের সফলতা নয়, কীভাবে একটি বিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন করে ফেলা যায়, শাহনাজ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যে বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষায় ৮০ জন শিক্ষার্থীকে ফেল করতে হতো, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি এসভি সরকারি সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়কে শতভাগ পাসের মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৯ বছর ধরে শতভাগ পাস ছাড়াও শীর্ষ জিপিএ-৫ অর্জনের গৌরব অর্জন করে আসছে শহরের এ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি।

Advertisement

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মো. শামসুল কবীর ও মা সুফিয়া কবীরের দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে শাহনাজ কবীর সবার বড়। জন্ম ১৯৭০ সালের ২৫ মার্চ। বাবা ছিলেন সহকারী পুলিশ সুপার। ছোট ভাই শফিকুল কবীর কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া মঠখোলা কলেজের প্রভাষক। আরেক ভাই ওয়াহিদুল কবীর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন। ছোট বোন সাবিহা কবীর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক।

১৯৯৮ সালে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বিয়ে হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে তাসনিম ইসলাম স্বর্ণা এবার মায়ের স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছে। ছোট মেয়ে তাহসিন ইসলাম রাফাও একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

শাহনাজ কবীরের দাদা তালেব আলী ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। মূলত তার প্রেরণায়ই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জাগে শাহনাজের। বাবা পুলিশ অফিসার হওয়ায় বিঘ্ন ঘটে শাহনাজের লেখাপড়ায়। বার বার স্কুল বদলাতে হয়।

নেত্রকোনার আটপাড়ায় একটি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। এরপর কেবলই ছুটে চলা। বাবার বদলি মানেই শাহনাজের স্কুল বদলি। প্রথম থেকে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতে গিয়ে তাকে ১০টি স্কুল বদলাতে হয়!

Advertisement

১৯৮৬ সালে মুন্সীগঞ্জ এভিজেএম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনটি বিষয়ে লেটারমার্কসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন লালমাটিয়া কলেজে। কিন্তু আবারও ফিরতে হয়। ১৯৮৮ সালে কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৯০ সালে লালমাটিয়া কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ পাস করেন ১৯৯২ সালে। ময়মনসিংহ টিটি কলেজ থেকে ১৯৯৪ সালে বিএড ও পরের বছর এমএড করেন।

১৯৯৭ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুলে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শাহনাজ কবীর। এরপর বিভিন্ন সময় চন্ডিপাশা উচ্চ বিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ উচ্চ বালক বিদ্যালয় ও ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা) সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কিশোরগঞ্জ উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে। ২০০৬ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কিশোরগঞ্জ শহরের এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেই থেকে স্বপ্নবোনা শুরু। ২০১০ সাল থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বদলে দেয়ার যাত্রা শুরু : এসভিতে যোগদানের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ। শাহনাজ কবীর এসভিতে যোগদানের বছর ২০০৬ সালে ওই স্কুলের ৩৫২ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মাত্র ২৬৯ জন পাস করে। জিপিএ-৫ পায় মাত্র ২৭ জন। এ অবস্থার উন্নতির জন্য কঠোর হতে থাকেন শাহনাজ। পরের বছর থেকে ভর্তিতে তদবির পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। বাড়তি নজর দেন পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের দিকে। অভিভাবকদের স্কুলে ডেকে এনে কথা বলেন সন্তানের বিষয়ে। বিষ্ময়কর ফল আসতে শুরু করে কয়েক বছর পর থেকেই। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপ্রতিরুদ্ধভাবে জেলায় শত ভাগ পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে শীর্ষস্থান দখল করে এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এ সময়ের মধ্যে ১৪১৩ জন জিপিএ-৫ পায়। শাহনাজ কবীর বিদ্যালয়টিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে পেরে নিজেদের গর্বিত মনে করেন অভিভাবকরা।

লেখাপড়ার পাশাপাশি মেয়েদের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে প্রগতিশীল চেতনায় বিকশিত করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। চারবার এ বিদ্যালয়টি শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।

ক্যান্সার জয়ী শাহনাজ : ২০১৭ সালের মার্চে হঠাৎ করেই প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীরের শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। তাকে ভারতে চিকিৎসা দেয়া হয়। জটিল চিকিৎসা শেষে দেশে আসার পর টানা ছয় মাস তাকে কেমো থেরাপি দিতে হয়। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও স্কুলের কথা ভুলে যাননি তিনি। ভারত থেকে ফিরে অসুস্থ অবস্থায়ও প্রতিদিন স্কুলে গেছেন।

দুপুরে এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে স্বভাবসুলভ হাসিতে ভরিয়ে তোলেন চারপাশ। কক্ষের বিভিন্ন স্থানে ভালোবাসা আর অভিনন্দন বার্তার ফুলের তোড়া। পেছনে বিদ্যালয়, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের অর্জিত অসংখ্য মেডেল-ট্রফি- স্মারকগুলো যেন জায়গা ধরছে না!

জাগো নিউজের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান দেশ সেরা শিক্ষক শাহনাজ কবীর। বলেন, মানুষের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকেই কাজ করি। কিছু পাওয়া জন্য নয়। তবে ছোটবেলা থেকে দুটি ইচ্ছা ছিল প্রধান শিক্ষক হওয়া এবং দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়া। দুটি আশাই আল্লাহ পূরণ করেছেন। এ জন্য মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই।

তিনি জানান, এ অর্জন আমার একার নয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সহকর্মী, অভিভাবক এবং সাংবাদিকরা সব সময় আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। তাদের কাছেও আমি ঋণী।

প্রসঙ্গত, দেশের শ্রেষ্ঠ ‘প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত হয়েছেন কিশোরগঞ্জ শহরের এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীর। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত করে।

এমএএস/এমএস