বিশেষ প্রতিবেদন

জোড়াতালি দিয়ে চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করাই হবে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো মানের শিক্ষক থাকলেও এ সংকট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্রতর। জোড়াতালি দিয়ে চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তাই কীভাবে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করব। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ।

Advertisement

আরও পড়ুন > শিক্ষায় গলদ আছে বলেই সমাজে বর্বরতা বাড়ছে

‘প্রয়োজনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা তৈরি করা হবে’ বলেও জানান তিনি। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ। সেই থেকে টানা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও অনেকদিন কাটিয়েছেন। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি নেন, পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা কাজও করেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং ইউজিসির আইন-কানুনের মধ্যে থেকে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করে যাওয়ার ঘোষণা দেন এ শিক্ষাবিদ।

ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে আমি অবগত। এখানে ভালো মানের শিক্ষক সংকট রয়েছে। নিয়মিত বা পূর্ণকালীন শিক্ষকও কম। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া ‘অ্যাডজাঙ্ক’ শিক্ষক বেশি থাকে। নিজেদের প্রয়োজনে ভালো মানের পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। কেননা এ ধরনের (অ্যাডজাঙ্ক) শিক্ষকের আনুগত্য ও বন্ধন প্রতিষ্ঠানের প্রতি থাকে না।

Advertisement

‘আমি প্রায় ২৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা করেছি। তাই এখনও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অনুগত্য ও ভালোবাসা রয়েছে, খণ্ডকালীন যারা পড়ান তাদের কিন্তু তা থাকার কথা নয়।’

তিনি বলেন, বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষকরা এটাকে ব্যবসা মনে করেন। তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কিছু দেখেন না। কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি দীর্ঘমেয়াদি কিছু না ভাবেন, তখন ওই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য তাদের কোনো অবদান থাকে না। কারণ ওনার তো ক্যারিয়ার নেই সেখানে। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আজ আছেন, কাল নাই। এ কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল, নাকি খোলা থাকল- এটা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না। আর যদি কেউ ওই প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী জনবল হন, তাহলে তিনি পদে পদে ওই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির চেষ্টা করবেন।

আরও পড়ুন > ‘নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলা পড়াচ্ছেন না, অন্য দেশে অচিন্তনীয়’

‘এখন এখানে যেটা চলছে সেটাকে জোড়াতালি দেয়া বলা চলে। জোড়াতালি দিয়ে চালানো কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক কিছু চিন্তা করা যায় না। প্রয়োজনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করব।’

Advertisement

এ শিক্ষাবিদের মতে, বিদেশে পাবলিকের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণ থাকে বেশি। কারণ সেখানে ব্যবসায়িক মানসিকতা নেই। আমাদের দেশের পরিস্থিতিটা কিন্তু ভিন্ন। অবশ্য কেউ কেউ অন্যভাবে নিয়েছেন এটা। ইতোমধ্যে কিছু ভালো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি গড়ে উঠেছে। তারা ভালো করছে। পাশাপাশি খারাপ ইউনিভার্সিটিও আছে, যেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে আদৌ লেখাপড়া হয় কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।

‘তবে আমরা এগুলো দেখব। আমাদের যে আইনকানুন, বিধিবিধান ও নীতিমালা আছে, তার আলোকে কাজ করব। আমরা রুলসটাকেই (আইন-নিয়ম) বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব। আমার সঙ্গে ইতোমধ্যে যারা দেখা করেছেন তাদেরকে বলেছি, তাদের হয়তো অনেক সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু শেষ কথা হচ্ছে, আইন ও নিয়ম মানতেই হবে। আইন অনুসরণ করলে এসব সমস্যা থাকবে না।’

‘সিস্টেমের মধ্যে সবাইকে আসতেই হবে’ উল্লেখ করে ইউজিসির নতুন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার প্রচেষ্টা থাকবে, যারা আইন ও নিয়ম মানেন না, তাদের এর মধ্যে নিয়ে আসা। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের দেশে অনেকের চিন্তা আছে, কম উদ্যম দিয়ে বেশি লাভ করা। কিন্তু শিক্ষার মধ্যে নৈতিকতা থাকতে হবে। আইন আছে, নিয়ম থাকবে। কিন্তু সেটার পাশাপাশি নৈতিকতা দিয়ে চলতে হবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, অনেক সময় পার হওয়ার পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু হয়নি। যারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছেন, তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু যারা যাননি, তাদেরকে যেতেই হবে।

আরও পড়ুন > শিক্ষার বৈষম্যকে প্রতিপালন করছে রাষ্ট্রই

‘স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়া নিয়ে তাদেরও (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) নানা কথা থাকতে পারে। তারা বলছেন যে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে স্থায়ী ক্যাম্পাস করেছি। স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছি, কিন্তু বিভাগ খোলার অনুমতি দিচ্ছে না। তাদের কথায় যুক্তি থাকতে পারে। সেসব আমরা দেখব। তাদের শাসন করতে আসিনি। ইউজিসির কাজ তাদের রেগুলেট (প্রয়োজন অনুসারে সংযত করা) করা। সেটার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার স্বার্থে তাদের দিকটা দেখব আমরা। কিন্তু আইন-নিয়ম মানতে হবে। রুল অব ল’ (আইনের শাসন) প্রতিষ্ঠা করাই হবে আমার মূল লক্ষ্য।’

ড. শহীদুল্লাহ বলেন, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার মান নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নাই। আমরা উন্নত দেশে উন্নীত হতে চাই। জাতীয়ভাবে সেই লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত ও যথাযথ লোক ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। উন্নত দেশে উন্নীত হতে যে উপযুক্ত লোক দরকার, তা তৈরিতে সরকার মনোনিবেশ করেছে। উপযুক্ত লোক তৈরি না করলে শ্রীলঙ্কা, ভারত বা অন্য দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে চলতে হবে। সেটা না চাইলে মানের উপর জোর দিতে হবে। এসব বিবেচনায় সরকার শিক্ষার মান নিশ্চিতে মনোনিবেশ করেছে।

‘তবে এ মান উন্নয়নের কাজটা শিক্ষকদের দিয়েই করতে হবে। আবার সমস্যা যেটা সৃষ্টি হয়েছে সেটাও শিক্ষকদের দ্বারাই হয়েছে। তাই এটার সমাধানও করতে হবে শিক্ষকদের। আজ এসএসসি-এইচএসসি পর্যায়ের জিপিএ-৫ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। শিক্ষকরাই আবার এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু কে এই জিপিএ-৫ দিয়েছেন। আমার কথা হলো যে, আমরা যে সিস্টেম তৈরি করেছি, সেই সিস্টেমই তো তিনি পেয়েছেন।’

‘আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫০ জন প্রথম শ্রেণি পাচ্ছে। আবার ওই বিভাগেরই শিক্ষকরা বলছেন, তাদের আমলে হলে ২-১টি পেত। প্রশ্ন হচ্ছে, দিতেছেন কেন? দিয়ে কি শিক্ষার মান বাড়ছে? তাত্ত্বিকভাবে বললে মনে হবে, তারা (প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত) উচ্চমানের শিক্ষার্থী। আসলে কি তারা ব্রিলিয়ান্ট? এর চেয়ে বড় প্রশ্ন, কে এই ব্রিলিয়ান্ট সার্টিফিকেট দিচ্ছে। দিচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই বা শিক্ষক বা শিক্ষা-ব্যবস্থা। তাই এগুলো নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।’

‘আমি মনে করি, মানের বিষয়টা নির্ভর করছে সিস্টেমের ওপর। সিস্টেম যদি ঠিক থাকে তাহলে ডেলিভারি অ্যান্ড এন্ড-রেজাল্ট (উপস্থাপনা ও সমাপনী ফল) সন্তোষজনক হবে। সিস্টেম যদি ঠিক না থাকে তাহলে দু-চারজন ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষক দিয়ে ‘এন্ড-রেজাল্ট’ ঠিক করা যাবে না। সার্বিক সিস্টেম ঠিক করতে হবে।’

আরও পড়ুন > পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাস নেন প্রাইভেটে, মান তো কমবেই

সার্বিক সিস্টেম ঠিক করার উপায়ও বাতলে দেন ইউজিসির নতুন চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটা থেকে উত্তরণের কাজটা শিক্ষককেই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভালো-মন্দ উভয়ের দায়ই শিক্ষকের। আজ যদি মানের কোনো প্রশ্ন ওঠে, তার দায়টা শিক্ষককে নিতে হবে। আর ভালো হলে এর কৃতিত্ব শিক্ষকেরই হবে। আমি এ ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের দোষ দেব না। তারা চাইবেই ক্লাসে না গিয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে। কিন্তু শিক্ষককে তো এটা দেখতে হবে।

‘আগের দিনের শিক্ষকরা বেতনের দিকে তাকাননি। সেন্স অব কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতির অনুভূতি) থেকে তারা শিক্ষকতায় আসতেন। শিক্ষকতা সবার জন্য নয়। এটা ভিন্ন ধরনের পেশা। এর অপর নাম প্রতিশ্রুতি। এটাই তার কাছে প্রত্যাশিত। তবে আমি সহকর্মী শিক্ষকদের দোষ দেই না। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি এখনও শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট রেসপেক্টফুল অ্যান্ড রিগার্ড (শ্রদ্ধাশীল ও সম্মানিত)। কিন্তু সার্বিকভাবে যুগের একটা প্রভাব আছে। সময়টা ব্যক্তির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। তাই গোটা সমাজকেই রি-থিঙ্ক (পুনর্চিন্তা) করতে হবে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগোব, কিন্তু নৈতিক দিক বিসর্জন দিয়ে নয়। আমাদের ব্যালান্স করে চলতে হবে।’

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ‘ছাত্র-শিক্ষক বন্ধনটা গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, শিক্ষকদের সবার ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের আপত্তি থাকে না। অনেক ব্যস্ত শিক্ষক, যারা জাতীয়পর্যায়ে ব্যস্ত, তারাও ঠিকমতো ক্লাস নেন। আবার কেউ কেউ ক্লাস নেন না। এখানে ছাত্র-শিক্ষক বন্ধনটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা যেন দুর্বল না হয়। শুধু ক্লাসরুমে লেকচার দেয়ার মধ্যেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসরুমে যেমন শিক্ষক, পাশাপাশি আমরা তাদের গাইড, দার্শনিক এবং প্রয়োজনে বন্ধুও। আমাদের সেভাবে কাজ করতে হবে। এ ধরনের শিক্ষকই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মডেল। আমি আমার সহকর্মীদের মডেল হওয়ার আহ্বান জানাব।

আরও পড়ুন > ‘সেরা ছাত্র হলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না’

বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, ভালো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হলে অনুমতি পেতে পারে। আমাদের দেশে এর চাহিদা হয়তো আছে। কেননা, অনেকে বিদেশে পড়তে যায়। তারা যদি দেশে বসেই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পাবে।

‘কিন্তু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতির ক্ষেত্রে আমাদের সিলেকটিভ (নির্বাচনশীল) হতে হবে। লন্ডন ইউনিভার্সিটি অব ইকনোমিক্স বা এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় যদি আসে তাহলে আমরা ভেবে দেখব। আমরা বিদেশের কোনো নামহীন বা ব্রিফকেস ইউনিভার্সিটির অনুমোদন দিতে পারি না। অনুমোদনের আগে অবশ্যই সেটা জেনুইন (ভুয়া নয়) কি না, দেখতে হবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা এর সেন্টার বা আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আবেদন যাচাইয়ের কাজ সতর্কতার সঙ্গে, পক্ষপাতহীনভাবে করতে হবে। দেখতে হবে সেটা কতটুকু আমাদের জন্য ভালো হবে। যে কেউ চাইলেই যে দেয়া হবে তা নয়। আর দেখার ক্ষেত্রে কাজটি অবশ্যই সৎ কর্মকর্তাদের দিয়ে করাতে হবে।’

এমএইচএম/এমএআর/জেআইএম