মামুন রশীদ। বিশিষ্ট ব্যাংকার। গবেষণা করছেন, লিখছেন অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে। ব্যাংক ব্যবস্থা, উন্নয়ন, বাজেটসহ অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর।
Advertisement
অর্থনীতির ওপর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বলেন, ‘ব্যাংক খাত প্রায় বিপর্যয়ের মুখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় নানা অনিয়ম গেড়ে বসেছে। অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর অধিক গুরুত্ব দেন এ গবেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।
জাগো নিউজ : ব্যাংক খাতের নানা আলোচনা বাজারে। অন্তত গত এক দশকে ব্যাংক নিয়ে ভালো খবর নেই বিশ্লেষকদের কাছে। বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
মামুন রশীদ : ব্যাংক তথা আর্থিক খাত মোটেই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। বিকাশমান অর্থনীতির জন্য একটি যুগোপযোগী ব্যাংক খাত খুবই প্রয়োজন।
Advertisement
আরও পড়ুন > আমেরিকার পুঁজিবাদকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
বিনিয়োগ দরকার ছোট-মাঝারি কলকারখানায়। কারণ প্রযুক্তির কারণে বড় কারখানাগুলোয় ধীরে ধীরে জনবল কমে আসবে। কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি।
কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা বড় বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে নিয়েছেন এবং সেই টাকা ফেরতও আসছে না। এ টাকার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়ে থাকতে পারে। গবেষণায় আসছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।
অথচ, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রত্যাশা, তারা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে, দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে।
Advertisement
আমাদের অতিরিক্ত শ্রমশক্তি বেকার অবস্থায় আছে। তাদের কাজে লাগানোর সাংবিধানিক তাগিদও আছে। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ যথার্থভাবে করতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বেই। আর এখানেই সঠিক নজরদারি নেই।
জাগো নিউজ : মানুষের হাতে প্রচুর টাকা। ভোগব্যয় বাড়ছেই...
মামুন রশীদ : হ্যাঁ, ব্যক্তির হাতে এখন প্রচুর টাকা। সেটা আনুষ্ঠানিকভাবেই হোক আর অনানুষ্ঠানিকভাবেই হোক, ব্যক্তির ভোগব্যয় বেড়েছে। প্রচুর মানুষ স্মার্টফোন কিনতে পারছেন। ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে পারছেন। প্রচুর লোক দেশের বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন। ভারতে চিকিৎসা নেয়া বিদেশি রোগীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তা-ই। ২০১৫ সালে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান হিসাব দেখিয়ে বলেছিল, দুই বছরে ভোগব্যয় ছিল প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর বছরে ভোগব্যয় বাড়ছে শতকরা সাড়ে ১০ ভাগের বেশি। ভোগব্যয় কী পরিমাণ বেড়েছে, তা সুপার শপগুলোতে গেলেই বুঝতে পারবেন। অর্থাৎ মানুষের হাতে টাকা আসছে। ব্যক্তিও ব্যাংকের একটি বড় পার্টনার। কিন্তু সেই ব্যক্তিকে ব্যাংকগুলো আশ্বস্ত করতে পারছে না। ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংকাররা এতই নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ছেন যে কারণে তারা অন্যদিকে মনোযোগও দিতে পারছেন না।
ব্যাংকের প্রযুক্তির উন্নয়ন করার কথা, এটিএম কার্ড জালিয়াতি বন্ধ করার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। ব্যক্তির জন্য ব্যাংকের পরিষেবা বাড়ানো যাচ্ছে না। আমানত ও ঋণের সুদের মধ্যে সমন্বয় আনা দরকার। তাতে নজর নেই। অথচ, সুদের গরমিল হতে থাকলে ব্যাংক খাত বড় ধরনের বিপদে পড়বে। এ কারণেই আমি মনে করি, ব্যাংক খাত খাদের কিনারায় রয়েছে।
আরও পড়ুন > বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা
জাগো নিউজ : এ বিপদের কারণগুলো যদি স্পষ্ট করতেন…
মামুন রশীদ : তিনটি কারণে ব্যাংক খাত নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। প্রথমত, ভুল লোকের হাতে টাকা চলে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ক্রমাগত ঋণখেলাপি এবং ঋণের টাকা পাচার হয়ে যাওয়া। এ কারণে ঋণের প্রবাহ যথার্থ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বা ব্যাংকের অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
জাগো নিউজ : রাজনৈতিক বিবেচনা আগেও ছিল…
মামুন রশীদ : হ্যাঁ, ছিল। এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সরকারি ব্যাংকে সাধারণত রাজনৈতিক বিবেচনা নিতে দেখেছি। কিন্তু এখন বেসরকারি ব্যাংকেও রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি, বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ সিডিউলে সরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা হস্তক্ষেপ করছে এবং সেটা রাজনৈতিক শক্তির বলেই।
আরও পড়ুন > সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ব্যাংক খাত
আর্থিক খাতে রাজনৈতিক মাখামাখির কারণে ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা করা যাচ্ছে না। ব্যাংকের স্বার্থ এবং মালিকের স্বার্থ কিন্তু আলাদা। অথচ মালিকের স্বার্থই এখন ব্যাংকের স্বার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালিকরা ব্যাংকের স্বার্থ দেখার পরিবর্তে রাজনীতি বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির স্বার্থ দেখতেই অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
জাগো নিউজ : আপনি ব্যাংকের নানামুখী সংকটের কথা বললেন। এরপরও তো ব্যাংকগুলো টিকে রয়েছে…
মামুন রশীদ : টিকে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে, ডিপোজিট বৃদ্ধি পাওয়া। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকের ডিপোজিট বেড়েছে চার হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। সুদের পরিমাণ বেশি থাকায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে।
ব্যাংক আসলে একদিনে মরে না। কারণ ব্যাংকের কাজই হচ্ছে টাকা নিয়ে লেনদেন। ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া এবং আমানত বাড়লে ব্যাংকগুলো আরও বেশি বেঁচে থাকবে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে আসলে বেঁচে থাকা বলে না।
জাগো নিউজ : সরকার তো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যেমন- ফারমার্স ব্যাংকে বিশেষ নজর দিল...
মামুন রশীদ : এখানেই সরকার ভুল করছে। ফারমার্স ব্যাংকের আসলে বেঁচে থাকার অধিকারই ছিল না। অথচ মৃতপ্রায় ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে দুর্বল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আরও দুর্বল করে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কেনার জন্য। সরকার নিজেই দ্বৈতনীতি অবলম্বন করছে। আর ব্যাংকগুলো সাধারণ জনগণের অধিকার বঞ্চিত করে সরকারের জোরে টিকে আছে।
বেশির ভাগ ব্যাংকের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্মম সত্য বলেছিলেন যে, ১০ থেকে ১৫টির বেশি ব্যাংক থাকা উচিত নয়। তিনি এক আলোচনায় দুঃখও প্রকাশ করেছেন।
জাগো নিউজ : সাবেক এ অর্থমন্ত্রীর আমলেই অনেকগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়…
মামুন রশীদ : বাধ্য হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে ব্যাংকের অনুমোদন দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক চাপের কারণেই অর্থমন্ত্রী জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। একই কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষরা নিজেদের কাজ নিজেরা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না।
এখন আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণমুখী, স্বাধীনচেতা, সৎ মানুষকে নিয়োগই দেয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সবক্ষেত্রে একমুখী হওয়ায় মানুষের অধিকার মার খেয়ে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ : রাজনৈতিক সরকার তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নেবে…
মামুন রশীদ : হ্যাঁ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই নেবে। কিন্তু রাষ্ট্র ও দুর্বৃত্ত যখন মাখামাখি হয়, তখন সেখানে জনকল্যাণ আর থাকে না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত একপেশে হয়ে যায় এবং বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থে কাজ করে। দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ী আর উদ্যোক্তার জন্যই এখন রাজনীতি।
আরও পড়ুন > সরকারের ব্যাংক নির্ভরতায় চাপে পড়বে বেসরকারি বিনিয়োগ
রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কোনো নিয়োগ নেই। রাজনৈতিক পরিচয় মিলে গেলেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এটি একটি ভয়াবহ চিত্র।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ কী?
মামুন রশীদ : দেশ এগোচ্ছে। কিন্তু এ এগিয়ে যাওয়া টেকসই হবে কি না, সবাই প্রশ্ন করছে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে মেধার চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। সেটা একটি ছোট প্রতিষ্ঠান হলেও। যেই সমালোচনা করছে, তাকেই ঘায়েল করতে দেখা যাচ্ছে এবং সেটা ধীরে ধীরে ব্যবসায় এসে প্রভাব পড়ছে।
ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে এক ব্যবসায়ী আরেক ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে বাধা সৃষ্টি করছেন এখন। ১৫ বছর আগে এমন মানসিকতা ছিল না। এমন চিত্র বিশ্বের আর কোথাও পাবেন না। অর্থনীতিতে শতভাগ সিদ্ধান্ত এখন রাজনৈতিক, যা সর্বনাশ ঘটাচ্ছে।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম