আশির দশকে আমাদের কৈশোর ছিল উত্তেজনায় ঠাসা। কত কিছু নিয়ে যে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতাম, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ববিতা না শাবানা, সাবিনা না রুনা লায়লা, সুনীল না শীর্ষেন্দু, ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা; এমন কত বিষয় নিয়ে আমরা লেগে যেতাম তার কোনো শেষ নেই।
Advertisement
আবাহনী-মোহামেডান খেলার দিন সারাদেশ ভাগ হয়ে যেতো। খেলা শেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হতো গুলিস্তান। আবাহনী-মোহামেডান খেলা মানেই অন্তত দুদিন সংবাদ শিরোনাম। আর ছিল ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াই। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের আগমনের আগে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে যেতো। কেন জানি না, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সমর্থকই বেশি ছিল। ঢাকার স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে বা 'আফ্রিদি ম্যারি মি' লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করার দৃশ্যও আমরা ভুলে যাইনি। তবে ক্রিকেটে পাকিস্তান নামতে নামতে এমন জায়গায় গেছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সেই উত্তেজনা আর নেই। খেলা হয় একতরফা। বরং ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তেজনা এখন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই মাঠে, মাঠের বাইরে, গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল লড়াই।
বাংলাদেশে দুই ধরনের পাকিস্তানী সমর্থক আছে এবং দুই ধরনের আটকেপড়া পাকিস্তানী আছে। প্রথমে আসি সমর্থকদের কথায়। কিছু লোক আছে, যারা নিছক ক্রিকেটিয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। ক্রিকেটীয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করার অনেকগুলো কারণ। একসময় পাকিস্তান এক্সাইটিং ক্রিকেট খেলতো। যে আনপ্রেডিক্টেবিলিটি ক্রিকেটের সবচেয়ে সৌন্দর্য, তার সবচেয়ে বড় সাইনবোর্ড পাকিস্তান। যে দলের গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যাওয়ার কথা, সেই দলের চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করা কেবল পাকিস্তানের পক্ষেই সম্ভব।
জাভেদ মিয়াদাদ, সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক থেকে শুরু করে আফ্রিদী পর্যন্ত; দারুণ সব ব্যাটসম্যান উপহার দিয়েছে পাকিস্তান। আবদুল কাদিরের মত অননুকরণীয় অ্যাকশনের গুগলি বোলারও পাকিস্তানের। ইমরান খানের মত সর্বকালের সেরা অধিনায়কও পাকিস্তানই উপহার দিয়েছে। তবে পাকিস্তান ক্রিকেটের সৌন্দর্য বা সমর্থনের আসল কারণ তাদের ফাস্ট বোলারদের আধিক্যে এবং বৈচিত্র্যে।
Advertisement
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া ফাস্ট বোলারদের এমন সমাহার আর কোথাও নেই। আকরাম, ওয়াকার, শোয়েব আখতার তাদের গতি দিয়ে একসময় বিশ্ব শাসন করেছেন। ডেথ ওভারে ওয়াসিম আকরামের ইয়র্কার বা গতির তোড়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প উপড়ে শোয়েব আখতারের ঈগল হয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা বিশ্ব ক্রিকেটেরই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যকল্পের জন্ম দেয়। পাকিস্তানে পেস বোলারদের এমনই প্রবাহ আকরাম-ওয়াকারের আমলে জন্ম নেয়ায় আকিব জাভেদের পেসার ঠিকমত খেলারই সুযোগ পাননি। এই যে এখন পাকিস্তান ক্রিকেটের এমন আকাল, তাও কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে সেরা বোলারদের একজনের নাম মোহাম্মদ আমির।
আমি কখনোই পাকিস্তান ক্রিকেটের সমর্থক ছিলাম না। তবে তাদের পেসারদের আক্রমণাত্মক স্টাইলে বহুবার মুগ্ধ হয়েছি। ভারতের পুতুপুতু স্পিনের বিপরীতে পাকিস্তানের গতির লড়াই আসলে মুগ্ধ হবার মতই। তাই যারা নিছক ক্রিকেটীয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করতেন বা করেন, তাদের ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু লোক আছে, যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। তাদের আমি বলি, আটকেপড়া পাকিস্তানী। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে দুই ধরনের আটকেপড়া পাকিস্তানী আছে। কিছু আছে শারীরিকভাকে আটকেপড়া, যারা নির্দিষ্ট ক্যাম্পে থাকে। আর কিছু আছে মানসিকভাবে আটকেপড়া, যারা ঘাঁপটি মেরে থাকে। সুযোগ পেলেই পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে স্টেডিয়ামে চলে যায়।
শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানীদের সহজেই চেনা যায়। মানসিকভাবে আটকেপড়াদের চেনা মুশকিল। তবে তাদের চেনার একটা কৌশল আছে আমার। ফেসবুকে পাকিস্তান নিয়ে কিছু লিখলেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমিও চিনে নেই। তাদের প্রধান অস্ত্র, খেলার সাথে রাজনীতি না জড়ানোর পরামর্শ দেয়া। আমিও নীতিগতভাবে খেলার রাজনীতি না মেলানোর পক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানের ব্যাপারে আমার ঘৃণাটা এতই তীব্র যে খেলার সাথে রাজনীতি না মেলানোর তত্ত্বে নীতিগতভাবে বিশ্বাস করলেও মন থেকে মেনে নিতে পারি না।
আমি দুঃখিত, আমি অতটা নির্মোহ থাকতে পারি না। পাকিস্তানকে সামনে পেলেই ঘৃণার বিষ উঠে আসে। কারণ আমি আমাদের ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস জানি, একাত্তরে গণহত্যার কথা জানি। পাকিস্তান সে গণহত্যার কথা কখনো স্বীকার করেনি। গণহত্যার দায়ে তাদের চিহ্নিত সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। বরং বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে, তখন পদে পদে তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করেছে। ফাঁসি হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সে দেশের পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব ওঠে।
Advertisement
তারা আমাদের লুটে নেয়া নেয়া সম্পদ ফিরিয়ে দেয়নি, আটকেপড়া পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে নেয়নি। তাই পাকিস্তান সম্পর্কে আমি নির্মোহ থাকতে পারি না। সবকিছুতে পাকিস্তানের পরাজয় আমাকে আনন্দিত করে। তবে সুখের কথা হলো, পাকিস্তান এখন প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তান এখন সবকিছুতেই তলানিতে। কয়েক বছর আগে পাকিস্তানকে হারানোর পর সিরু বাঙালি নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ২০ জুন পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্যদের মৃত্যুগুহা থেকে ফিরে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, গত রাতে মাশরাফি বাহিনীর পাকিস্তান বধে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি। আমার যদি তেমন ক্ষমতা থাকত, ওদের প্রত্যেককে আমি তাহলে একটা করে বাড়ি উপহার দিতাম।’
মানুষের আবেগের আসলে কোনো বলা-কওয়া নেই। মুখে বললেই, খেলার সাথে রাজনীতি না মেশানোর মত নির্মোহ হওয়া সম্ভব নয়। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তেজনা তো রাজনৈতিক কারণেই। ১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের ম্যাচ অমন উত্তেজনা ছড়িয়েছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণেই। তাই বললেই রাজনীতিকে দূরে রাখা যায় না।
পাকিস্তানের ব্যাপারে যে মনোভাব, ভারতের ব্যাপারে তা নয়। আমার ক্রিকেট দেখা শুরু আশির দশকে। তখন সীমান্তবর্তী কুমিল্লা শহরে বাঁশের আগায় থালাবাটি বাঁধলে ভারতের দূরদর্শন দেখা যেতো। দূরদর্শনে আমরা মূলত ক্রিকেট দেখতাম। কুমিল্লার টমসমব্রিজে নিউ হোস্টেলে কুন্ডু গোপী স্যারের বাসায় খেলা দেখতাম। স্যার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থক। দেখাদেখি আমিও ক্যারিবীয় ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে যাই। ভিভ রিচার্ডস এখনও আমার আইকন। গার্নার, মার্শাল, ওয়ালশ, অ্যামব্রোসরা বছরের পর বছর দখল করে রাখেন কোটি ভক্তের হৃদয়।
আমার ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রেম থেমেছে ব্রায়ান লারায় এসে। তবে তখন আমার দ্বিতীয় পছন্দের দল ছিল ভারত। সুনীল, কপিল, শ্রীকান্ত, ভেংসরকার থেকে শুরু করে গাঙ্গুলী, শচীন পর্যন্ত চলেছে এই ভালোবাসার খেলা। এখনও আমি মনে করি শচীন টেন্ডুলকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়। কঠোর অধ্যবসায় আর শৃঙ্খলা একজন মানুষকে কোথায় নিতে পারে, শচীনের কাছ থেকে সেটা সবাই শিখতে পারে। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে পৌরুষ এনেছেন সৌরভ গাঙ্গুলী।
লর্ডসের ব্যালকনিতে তার জার্সি খোলা উল্লাসই আসলে ভারতকে লায়েক বানিয়েছে। শচীনের পর ভারতের হাল ধরেন বিরাট কোহলী। কিন্তু এই বিরাটকে দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। একসময় এই ভারতের জন্য গলা ফাটিয়েছি, এটা ভাবতেই অবাক লাগে। এখন ক্রিকেট মাঠে ভারতের প্রতিটি পরাজয় আমাকে উল্লসিত করে। দুদিন আগে আফগানিস্তান যেভাবে ভারতকে নাকানি-চুবানি খাওয়ালো, কী যে আনন্দ লেগেছে বলে বোঝানো যাবে না। ভারত একসময় আমার পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় ছিল, এখন অপছন্দের তালিকায় দ্বিতীয়, পাকিস্তানের পরেই। এই বদলটা ঘটলো কিভাবে? সেই গল্পটাই বলবো আজ।
বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে আবির্ভাবের পর থেকে বদলে গেছে আমার সমর্থনের প্যাটার্ন। এখন আমার বুকজুড়ে শুধু বাংলাদেশ। কোন দল জিতলে বাংলাদেশের লাভ হবে, সেটাই আমার একমাত্র বিবেচনা। যদি আজ শুনি কোনো ম্যাচে পাকিস্তান জিতলে বাংলাদেশের লাভ হবে, তবে আমি একদিনের জন্য হলেও পাকিস্তানের জয় চাইবো। ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে আমাকে প্রায় বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ এনে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে একই অনুভূতি হয় ভারতকে হারিয়ে। তবে ভারত সে পরাজয়ের তেতো স্বাদ ভুলতে পারেনি। কারণ সেবার তারা সেরা দল নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বকাপ জিততে। তাদের সে পাকা ধানে মই দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই থেকে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই উত্তেজনার বারুদে ঠাসা। ভারত ২০০৭এর প্রতিশোধ নিয়েছিল ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। নির্লজ্জ আম্পায়ারিঙে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। সেই থেকে ক্রিকেট ইন্ডিয়া বাংলাদেশে ভিলেন। অন্তত ক্রিকেটে বাংলাদেশে ভারতের সমর্থক এখন তলানিতে।
এই সুযোগটাই নিয়েছে বাংলাদেশে মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানীরা। তারা সুকৌশলে ক্রিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চায় ভারতবিদ্বেষ। কিন্তু আমি কখনোই ভারত আর পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মাপি না। একাত্তরে পাকিস্তান আমাদের ওপর নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছিল আর ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল, পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমরা তাদের ভুলিনি, আমরা কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভারতীয় ক্রিকেট সংগঠক জগমোহন ডালমিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান, বলা ভালো, বেশ খানিকটা পক্ষপাতপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নে ভারত যা করতে পারতো, যা করা উচিত ছিল; তার কিছুই করেনি। অনেকদিন আমন্ত্রণই জানায়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত পাশে ছিল, আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মানে তারা মাথা কিনে নেয়নি। ভারতকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, সব কিছু হতে হবে মর্যাদার ভিত্তিতে। বড় ভাইয়ের মত পাশে থাকলে ভালো, দাদাগিরি করলে জবাব হবে দাঁতভাঙ্গা। আমি জানি, আপনি বন্ধু বদলাতে পারবেন, প্রতিবেশী নয়। তাই ভারতের সাথে একটা সুপ্রতিবেশীসুলভ, মর্যাদাপূর্ণ সুসম্পর্ক চাই। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই, চাই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে। যতদিন না হবে, প্রতিবাদ চলবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে আসার পর আমার একটাই পছন্দ, হৃদয়জুড়ে শুধু বাংলাদেশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশের অনেকের হৃদয়ের অনেকটা জুড়েই এখনও পাকিস্তান বা ভারত। এমনকি বাংলাদেশের সাথে খেলা হলেও পাকিস্তান বা ভারতের জয় চান, এমন কিছু লোককেও চিনি। তাদের জন্য করুণা। আমাদের সবার হৃদয়জুড়ে, বুকজুড়ে থাকুক বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
এইচআর/পিআর