সামাজিক শিক্ষা তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, শিক্ষা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই শিশুদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। শিক্ষার দুটি স্তর : সামাজিক ও ব্যক্তিগত। শিশুর সাংস্কৃতিক বোধ, যুক্তিবাদ, স্মৃতি, মনোযোগ, মতামত গঠন প্রথমেই ঘটে সামাজিক স্তরে, পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে। পরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে, নিজের মধ্যে। ভাষা, গণিত বা বিজ্ঞান-যাই হোক না কেন, শিখতে হবে পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে, শুধু বই বা শিক্ষকের ওপর নির্ভর করে নয়।
Advertisement
বলা হয়ে থাকে, বই হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞান স্থানান্তরের একটি মাধ্যম এবং শিক্ষকরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থপূর্ণ করে তোলেন। কিন্তু শুধু এই দুইটি মাধ্যমই শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বা অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় সামাজিক, তাহলে সমাজ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি শিশুকে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে দিতে হবে সবার আগে। মূলতঃ স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার সামাজিকীকরণের কেন্দ্র। স্কুলে যদি শুধু বই-খাতা বা কম্পিউটার দিয়েই পড়ানো হয়, সেটা কি বাড়িতেই করা যেত না?
শুধু তাই নয়, প্রাথমিক পর্যায়ের কারিক্যুলামে শুধু বিষয় ভিত্তিক পড়া ও লেখা রাখলেই চলবে না, বরং সফটস্কিলস বলে পরিচিত যোগাযোগ, দলবদ্ধতা, অভিযোজন, সমস্যা-সমাধান, সৃজনশীলতা, নৈতিকতা, আন্তঃব্যক্তিগত সম্পর্ক, সময় ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, বিস্তারিত মনোযোগ- এই দশটি দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে যেন আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সামাজিক ও কর্ম জীবনে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে । এছাড়াও, আধুনিক শিক্ষার মূল মন্ত্র হলো "লার্ন টুগেদার", যার অর্থ হলো শিক্ষার্থীকে শুধু নিজের সক্ষমতার ওপর ছেড়ে দেয়া যাবে না; বরং তাকে আশে-পাশের পরিবেশ ও সহপাঠীদের সাথে থেকে শেখার সুযোগ দিতে হবে।
এমনকি মেধা বা জ্ঞানের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও দলবদ্ধ-প্রচেষ্টার সুযোগ থাকতে হবে, যা শুধু পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সরকারকে সাধুবাদ জানাই এলিমেন্টারি লেভেল বা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ার জন্য। কেননা, পরীক্ষা হচ্ছে মূল্যায়নের সেই মাধ্যম যাতে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের চেয়ে ষ্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত দক্ষতা বেশি পরীক্ষিত হয় যাতে সাধারণত বয়সে বড় বা মানসিক ভাবে পরিপক্ক শিক্ষার্থীরা বেশি লাভবান হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের টিম-ওয়ার্ক বা দলবদ্ধ ভাবে কাজ করার ক্ষমতা বিবেচনা করারও সুযোগ থাকে না।
Advertisement
এলিমেন্টারি বা প্রাথমিক পর্যায়ে যেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা গড়ে দু' থেকে তিন ঘন্টা স্কুলে থাকে, সেখানে বাইরের দেশগুলিতে প্লে-গ্রুপ থেকেই শিশুরা ছয় থেকে সাড়ে ছয়ঘন্টা স্কুলে কাটায়। এতো দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীরা পরিবারের চেয়েও সহপাঠী ও শিক্ষকের সাথে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পায়, যাতে করে সে তার সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব এবং সামাজিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় অল্প বয়সেই। সেই সাথে বিভিন্ন জরুরি সময়ে পরিবারের সাহায্য ছাড়া খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রশিক্ষণ ও পেয়ে যায়। এবং, নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা বুঝতে ও বলতে শিখে যা তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, প্রতিটি শিক্ষার্থী পারিবারিক প্রভাব মুক্ত হয়ে যে কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভিন্নতা ও সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয় যা তাকে গ্লোবাল বা বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
এর বাইরে, শিশুরা দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকলে বাবা-মায়ের কাজের সময় ও সুযোগ বাড়ে এবং শিশুরা বাড়ি ফেরার পর তারা সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন। যদিও বর্তমান ব্যবস্থায় অধিকাংশ মা-বাবাই বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়ার সময়ের ফারাক কম হওয়ায় প্রায়ই বিপাকে পড়েন এবং স্কুল গেইটে অপেক্ষা করেই অনেক সময় নষ্ট করেন, যে কারণে দিনের বাকি অংশে শিশুদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার মতো যথেষ্ট সুযোগ তাদের থাকে না।
তাছাড়াও, দিনের বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকার কারণে ও বাবা-মায়ের ব্যস্ততার সুযোগে প্রাথমিকে পড়া বেশিরভাগ শিশুই, বিশেষ করে শহরে, কম্পিউটার বা টিভির স্ক্রিন-আসক্তিতে ভুগছে যা তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। খুব কমন একটি সমস্যা যা ইদানিং বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো, অনেক শিশুই এখন দীর্ঘদিন পর্যন্ত পরিষ্কার একটি ভাষায় কথা বলতে পারে না শুধু টিভি বা ইউটিউবে একাধিক ভাষা শুনার কারণে এবং একক পরিবারে বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে বাস্তবিক জীবনে নিজের ভাষায় পর্যাপ্ত কথোপকথনের সুযোগ না থাকায়। ভাষাবিদরা এটিকে ল্যাংগুয়েজ স্যোশালাইজেশন এর অভাব বলে আখ্যায়িত করছেন।
সামাজিক শিক্ষার প্রধান তিনটি বিষয় হলো সংস্কৃতি, ভাষা, এবং মেধা বিকাশের নিকটতম ক্ষেত্র। এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও সহপাঠীরা কিভাবে শিশুদের ভাষা ও জ্ঞান আহরণে সহায়তা করে এবং সেই সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা সমূহ কিভাবে তাদের শিক্ষাকে প্রভাবিত করে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। কেননা, মস্তিষ্কের সমস্ত উচ্চতর ফাংশন গুলি উদ্ভূত হয় দুই বা ততোধিক ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক হিসেবে। শিক্ষার্থীর সাথে তার সহপাঠী ও পারিপার্শ্বিকতার যে আদান-প্রদান হয়, আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তা অনেকাংশেই অবহেলিত। বরং আমরা এই সম্পর্কটিকে সীমাবদ্ধ করে রাখি শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা লেখক-শিক্ষার্থীর মাঝে।
Advertisement
আমি এখানে স্বল্প পরিসরে সামাজিক শিক্ষা প্রয়োগের কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি এবং শিক্ষকরা সাধারণত নিজেদের মতো করে এরকম অনেক পদ্ধতি তৈরি করেন :
১. শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি ফ্রি-টাইম দিতে হবে যেন তারা নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয় ছাড়াও পড়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে পারে, এবং তার নিজের জানার সাথে অন্যের জ্ঞান বা বোধের তুলনা করতে পারে। সেটা অবশ্যই শুধু টিফিন-ব্রেক নয়, বরং শিক্ষক নিজের তত্ত্বাবধানেই তাদেরকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দিবেন। আলোচনা শেষে শিক্ষার্থীরা সেটার ওপর মৌখিক রিপোর্ট করবে।
২. নতুন কোনো পড়ার বিষয় বা গণিতের এর অনুশীলন সমাধান করতে দিলে সেটা শুরুতেই শিশুদের একা করতে না দিয়ে দুজনে মিলে করতে দিতে হবে এবং দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে একা সমাধান করবে। দলবেঁধে ক্র্যাফট বানাতে বা ছবি এঁকে গল্প লিখতেও দেয়া যেতে পারে।
৩. খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা থেকে আমাদের শিশুরা বঞ্চিত হয় তা হলো বাড়ি থেকে প্রস্তুতি নিয়ে এসে নিজের পছন্দ মতো একটি বিষয়ে প্রেজেনটেশন করা বা বক্তৃতা দেয়া। এই একটি পদ্ধতি প্রতিটি খুদে শিক্ষার্থীকে ভাষা গত দক্ষতার পাশাপাশি ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেকদূর।
৪. ভিন্ন কোনো ঋতু বা আবহাওয়ার দিনে শিশুদের দুই ক্লাসের মাঝের সময়টিতে বাইরে যেতে দিন এবং দিনটি কেন আলাদা, কি কি পরিবর্তন হলো, কেন এমন হতে পারে তা ফিরে এসে রিপোর্ট করতে বলুন।
৫. পাতা ঝরার দিনে একটি করে পাতা সংগ্রহ করে সেই পাতার ছবি আঁকতে দিন, সেটা রুম টেম্পারেচার এ রেখে দিয়ে প্রতিদিনের পরিবর্তন রিপোর্ট করতে বলুন, কত দিনে শুকালো সেটা লক্ষ্য করতে বলুন; বিজ্ঞানের প্রথম গবেষণা এভাবেই শুরু হোক।
৬. প্রতি তিন মাসের একটি টার্মে একবার করে আশে-পাশের কোনো উল্লেখযোগ্য স্থানে ঘুরতে বা ট্যুর করতে নিতে হবে এবং ফিরে এসে সেখানে কি দেখলো তা নিয়ে গ্রুপে আলোচনা করে মৌখিক রিপোর্ট করতে বলুন।
৭. এছাড়াও, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো রিসেস বা ছোট বিরতি যখন শিশুরা বাইরে গিয়ে একটু খেলা করে আবার পুনরুদ্দমে ক্লাসে বা পড়াশোনায় ফিরে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্যায়াম, খেলা-ধুলা বা যে কোনো শারীরিক কসরত সেরোটোনিন নামক হরমোন-প্রবাহকে প্রভাবিত করে যাতে ব্যক্তির আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে (বনোমো, ২০১০)।
৮. কারিকুল্যাম এর বাইরে বাড়ির কাজ দিন; বাবা-মায়ের সাথে কাজ করা, বৃষ্টিতে ভেজা, রান্না করা, খেলার জিনিসের রং ও আকার অনুযায়ী শ্রেণীভেদ করা, প্রতিবেশিকে সাহায্য করা, প্রতিদিন একটি ভালো কাজ করে লিখে রাখা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের যে আবহাওয়া তাতে অবশ্যই কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের ছয়ঘন্টা স্কুলে রাখা যায় না। তবে, বর্তমানে বরাদ্দকৃত সময়ের সাথে অতিরিক্ত এক বা দু' ঘন্টা যোগ করলেই প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা পিয়ার-লার্নিং, কার্যকরী-শিক্ষা (একটিভ লার্নিং), ও ভাষা-সামাজিকীকরণ (ল্যাঙ্গুয়েজ-সোশালাইজেশন) এর জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পেতে পারে।
সেই সাথে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে ক্লাসরুমে গোলটেবিল এ মুখোমুখি বসানোর পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে যথেষ্ট আলো-বাতাস পূর্ণ একটি খোলা জায়গা বা মাঠ রয়েছে, যেখানে শিশুদের সাথে পরিবেশ ও সহপাঠীদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া সম্ভব। তবেই এটি জীবন-মুখী শিক্ষা নিশ্চিত করে তাদের পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা।
এইচআর/পিআর