টিম হোটেলে কড়া নিরাপত্তা। যেন একটি মশা-মাছিও ঢোকার অনুমতি নেই। কিন্তু কর্তব্যের তাগিদে আর বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে নিজ দেশের জাতীয় দলের খোঁজখবর নিতে যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।
Advertisement
তাই আজ দুপুর ১২টা (বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা) বাজতেই বাংলাদেশের টিম হোটেল গ্র্যান্ড রিভারের সামনে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা সাউদাম্পটনের একেক জায়গা থেকে কেউ ট্যাক্সিতে কেউ বা পায়ে হেটে এসে সমবেত হলেন। ওদিকে ঠিক বেলা ১২টায় হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু।
পরিচিত সাংবাদিকদের সাথে দেখা অনেকদিন পর, হলো সৌজন্যতা বিনিয়ম। খানিক কথোপকথনের পর বাংলাদেশ দলের সর্বশেষ অবস্থা আর আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচ এবং সাইফউদ্দিন-মোসাদ্দেকের ইনজুরি নিয়েও দুই দফা কথা বললেন নান্নু।
স্বদেশি প্রচার মাধ্যমের সাথে দুই দফা কথাবার্তা শেষে প্রধান নির্বাচক ট্যাক্সি চেপে বাইরে বেরিয়ে যেতেই দেখা মিললো লিটন দাসের। লাল রংয়ের জ্যাকেট পরা লিটন ট্যাক্সিতে চড়ে বাইরে যাবার আগেই তাকে ঘিরে ধরলেন জাতীয় পতাকা হাতের এক প্রবাসী বাঙ্গালী, সঙ্গে দুজন ইংলিশ ভদ্রলোক। তারা অটোগ্রাফ নিলেন।
Advertisement
এরপর অপেক্ষার প্রহর বাড়লো বাংলাদেশের সাংবাদিক বহরের। মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, আজ দুপুর ১টা ২০ মিনিটে ঐচ্ছিক অনুশীলনের আগে একজন ক্রিকেটার কথা বলবেন। সেজন্য অপক্ষো করতেই হলো।
বাংলাদেশি সাংবাদিকদের পাশে হঠাৎ দেখা গেল আরও জন তিন চারেক ইংলিশ-বৃটিশকে। তারাও উসখুশ করছিলেন। কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইতেই খানিক অসন্তোষ আর বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন একজন, ‘আমি পিটার। আরে ভাই কি বলবো বলো?। অটোগ্রাফ নেয়া আর বিশেষ করে ছবির ওপরে ক্রিকেটারদের সাক্ষর কালেকশন করা আমার শখ। বেশ কিছু দিন ধরে এই শখের কাজটা খুব ভাললাগা আর ভালবাসার মিশেলে করছি আমি। কিন্তু কি বলবো? এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ পেতে আমার নাভিঃশ্বাস উঠে যাচ্ছে।’
কেন? তারা বুঝি অটোগ্রাফ দিতে চাইছেন না? পিটারের উত্তর, ‘আরে না, না। তোমাদের ক্রিকেটাররা মানুষ হিসেবে খুব ভাল। ওদের মনটা অনেক নরম আর উদার। সবাই হাসিখুশি। কিন্তু আমরা তো এবার কাছেই যেতে পারছি না। নিরাপত্তা কর্মীরা ক্রিকেটারদের কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আমি বেশ কয়েকবছর ধরেই ক্রিকেটারদের ছবিতে অটোগ্রাফ নেই। কিন্তু নিরাপত্তার নামে এত কড়াকড়ি, বাড়াবাড়ি দেখিনি কখনো। তাই তো তোমাদের পাশাপাশি হোটেলের বাইরে এই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে-বসে অপেক্ষা করছি কখন বের হবেন মাশরাফি।’
পাশে দাড়ানো টনিও যোগ করলেন, ‘এই তো দুবছর আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর বসেছিল যুক্তরাজ্যে। তখন আমি মাশরাফি-তামিমদের ছবি তুলে তাতে তাদের অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম। আর এবার তাদের ছবিতে অটোগ্রাফ নিতে গিয়ে কি যে ভোগান্তির শিকার হলাম। বারবার নিরাপত্তা কর্মীদের চোখরাঙানি দেখতে হচ্ছে।’
Advertisement
এর মধ্যে বাইরে থেকে আসলেন সাকিব আল হাসান। পিটার, টনি, ড্যানিয়েল আর এক বৃটিশ দৌড়ে গেলেন অটোগ্রাফ নিতে। সাকিব হোটেলে ঢুকে যেতে তাদের উন্মুখ অপেক্ষা। শুনেছেন মাশরাফি আসবেন কিছুক্ষণ পর, প্র্যাকটিসে যাবেন। টিম বাস রেডি। মাশরাফি বেরিয়ে আসা মাত্র ছুটলেন তারা। তবে সেটা টিম বাসের খুব কাছে।
মাশরাফির ছবিতে অটোগ্রাফ নেবার পর বাংলাদেশের তিন অনলাইন সাংবাদিকের সাথে খানিকক্ষণ কথা বললেন পিটার, টনি আর ড্যানিয়েল। জানালেন, নিছক শখের বশেই তারা ক্রিকেটারদের ছবিতে অটোগ্রাফ নেন এবং তা নিজের সংগ্রহে রেখে দেন।
এর মধ্যে পিটার আর টনি দুজনই ষাটের ওপরে বয়স। কর্ম জীবন শেষে এখন অবসরপ্রাপ্ত। অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। আর সুযোগ পেলেই ক্রিকেটার, ফুটবলার ও গলফারদের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। পিটার জানালেন, ৯ বছর ধরে এই অটোগ্রাফ শিকারের কাজ করছেন। ক্রিকেটারের পাশাপাশি ফুটবলার আর গলফারও আছেন তার সংগ্রহে।
এ ইংলিশ অটোগ্রাফ শিকারি গত নয় বছরে কতটা মনপ্রাণ দিয়ে ছবির ওপরে ক্রীড়াবিদদের অটোগ্রাফ সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছেন, তার নমুনা শুনলে বিস্মিত হবেন। এখন পর্যন্ত ৯০০০ ক্রীড়াবিদের ছবির ওপরে অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছেন।
জানালেন, বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি আর তামিম খুব পছন্দের। ২০১৭ সালে এই যুক্তরাজ্যের মাটিতে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম বারের মত তার সাথে মাশরাফির পরিচয় হয়। পরিচয় পর্বটা কিভাবে হলো? কিভাবে মাশরাফির কাছে গেলেন, তাকে আপনার ইচ্ছেটা বললেন কিভাবে?
পিটার গল্পের ছলে বলতে শুরু করলেন, ‘আরে তারও এক গল্প আছে। আমার সাথে সাবেক শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যান হাসান তিলকারাত্নের সম্পর্ক খুব ভাল। সে আমার পূর্ব পরিচিত। তার মাধ্যমে আমি মাশরাফির কাছে যাই এবং বলি আমি সৌখিন অটোগ্রাফ শিকারি। তোমার ছবিতে অটোগ্রাফ নিতে চাই। মাশরাফিও সানন্দে রাজি হয়ে যায়। সেই থেকে আমি যখনই সুযোগ পেয়েছি, ততবারই মাশরাফির ছবিতে অটোগ্রাফ নিয়েছি।’
ওদিকে অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না ড্যানিয়েল। ২৫ থেকে ৩০’র মধ্যে বয়স, সুদর্শন এই ইংলিশ জন্মসূত্রে লন্ডনের বাসিন্দা। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তার হাতে শোভিত হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সবুজ জার্সি পরা গ্রুপ ছবি।
সেখানে সবার ছবির ওপরে না হয় পেটে অটোগ্রাফ আছে। ড্যানিয়েলের অপেক্ষা পেসার রুবেল হোসেনের জন্য, ‘আমার প্রায় সবার অটোগ্রাফ নেয়া হয়ে গেছে। শুধু রুবেল হোসেনের অটোগ্রাফ নেয়া বাকি। তার জন্যই বসে আছি।’
ক্রিকেটার, ফুটবলাররা মাঠে খেলেন। তাদের পারফরমেন্সে দর্শক-ভক্তরা হন উদ্বেলিত, পুলকিত। আর তাদের অটোগ্রাফ শিকারিরা নিরবে নিভৃতে নিজের সংগ্রহভান্ডারে জমা করেন ক্রিকেটার, ফুটবলার ও গলফারদের অটোগ্রাফ।
এমন তিনজন পিটার, টনি আর ড্যানিয়েলের একাগ্রতা ও আন্তরিক ইচ্ছে দেখে একটি কথাই মনে হলো, এ জগত সংসারে মানুষের মন কত বিচিত্র! তারা বাংলাদেশের সমর্থক, ভক্ত নন। তবুও তাদের সংগ্রহে আছে মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদসহ সব ক্রিকেটারে ছবির ওপরে স্বাক্ষর।
এগুলো একদিন ইতিহাস হবে। হয়ত আর্কাইভে শোভিত হবে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপাড়ের মাশরাফি-তামিমরা এভাবেই বছরে পর বছর, যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন ইংলিশ অটোগ্রাফ শিকারী টনি, পিটার আর ড্যানিয়েলদের সংগ্রহে।
এআরবি/এসএএস