মালয়েশিয়ায় আটক বিদেশিদের খাবারের খরচ প্রতিমাসে ৩.৫ মিলিয়ন রিংগিত। সরকার বিদেশি বন্দিদের পেছনে প্রতিমাসে প্রায় মালয় রিংগিত ৩.৫ মিলিয়ন খাবারের জন্য ব্যয় করছে। গত ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঈদ পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক দাতুক খায়রুল দাজাইমি দাউদ সাংবাদিকদের এসব জানান।
Advertisement
তিনি বলেন, আটকদের দ্রুত নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠালে এ খরচ কমে আসবে বলেও জানান তিনি। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বাংলাদেশিসহ ৯ হাজার ৬৫৪ জন বন্দি রয়েছেন। এসব বন্দিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা শেষে দেশে ফেরত যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। জানুয়ারি থেকে জুনের ১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশিসহ ১ লাখ ৩ হাজার ২২৪ জন অবৈধ অভিবাসীর নথিপত্র চেক করা হয়।
এর মধ্যে ৮ হাজার ২৭৭টি অভিযানে আটক করা ২৮ হাজার বিদেশি শ্রমিকদের। ইতোমধ্যে বহু বিদেশি অভিবাসী যার যার দেশে ফেরত গেলেও গুরুতর অপরাধে ৯ হাজার ৬৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে অভিবাসন বিভাগ।
দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৪টি ইমিগ্রেশন ডিপোতে আটক এসব অবৈধ অভিবাসীদের এক থেকে দুই মাসের জন্য সেখানে রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে তাদের কূটনৈতিক মিশন (দূতাবাস) দ্বারা পরিচয় ও আনুষঙ্গিক কার্যাদী সম্পন্ন শেষে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
Advertisement
মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক দাতুক খায়রুল দাজাইমি দাউদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ১৪টি ডিপোতে ৯ হাজার ৬৫৪ জন আটক রয়েছে। আটকদের মধ্যে ৭ হাজার ৬৫০ পুরুষ, এবং নারী ও শিশু রয়েছেন ১ হাজার ৬৬৪ জন।
এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ৩ হাজার ৭৬৭ মিয়ানমার ২ হাজার ১০৫, বাংলাদেশ ১ হাজার ৫২৪, ভারত ১ হাজার ৫২৫, ভিয়েতনাম ২৯৪, পাকিস্তান ২৬৩, থাইল্যান্ড ২২৬, ফিলিপাইন ২২২, নেপাল ১৯৩, নাইজেরিয়া ১৫০ এবং বাকিরা বিভিন্ন দেশের ৩১৫ জন।
তিনি আরও বলেন, বুকিত জলিল, কুয়ালালামপুর,কেলআইএ, সেপাং, লেংগিং, নেগরি সেমবিলান, জুরু ও পুলাউ পেনাং ডিপো থেকে আটকদের মধ্যে কিছু অভিবাসীদের আমরা দ্রুত যার যার দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
এদিকে মালয়েশিয়ার লেংগিং ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর মো. জহিরুল ইসলাম। ২১ জুন শুক্রবার ক্যাম্প পরিদর্শনের আগে সকাল সাড়ে ১০টায় নেগরি সেম্বিলান ইমিগ্রেশন বিভাগের অ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর ও লেংগিং ক্যাম্পের কমান্ডার জুরাইন বিন মো. ইদ্রিছের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
Advertisement
সাক্ষাত শেষে তিনি বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বন্দিদের খোঁজখবর নেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, দূতাবাসের শ্রম শাখার কল্যাণ সহকারী জাহাঙ্গীর আলম ও লোকমান আহমদ।
এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন নেগরি সেম্বিলান ইমিগ্রেশন বিভাগ ও লেংগিং ক্যাম্পের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ক্যাম্পে থাকা বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশে পাঠানো এবং অহেতুক বাংলাদেশি কর্মীদের হয়রানি না করার আশ্বাস দেন কামান্ডার জুরাইন বিন মো. ইদ্রিছ।
প্রশ্নের জবাবে শ্রম কাউন্সিলর বলেন, প্রত্যেকটি ক্যাম্পে কতজন বাংলাদেশি আটক রয়েছে তাদের তালিকা দ্রুত মিশনে পাঠাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ ক্যাম্প থেকে যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে তাদের দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।’
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, বিভিন্ন কারাগার ও ক্যাম্পে যারা আটক আছেন, তাদের বেশিরভাগই অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ কিংবা অবৈধভাবে থাকার কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন, ১৯৫৯-এর ধারা ৬ (১) সি/১৫ (১) সি এবং পাসপোর্ট আইন, ১৯৬৬-এর ১২ (১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
দেশটির সিমুনিয়া, লেঙ্গিং, জুরুত, তানাহ মেরায়, মাচাম্বু, পেকা নানাস, আজিল, কেএলআইএ সেপাং ডিপো, ব্লান্তিক, বুকিত জলিল ও পুত্রজায়া বাংলাদেশি রয়েছেন যাদের সাজা শেষ হচ্ছে, তাদের দেশে পাঠানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাগ্য ফেরানোর নেশায়, দালালদের প্রলোভনে পরিবারে স্বচ্ছলতার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের অনেক যুবক লুফে নেন স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ। তবে মালয়েশিয়া যাত্রা শুরুর আগে তারা উপলব্ধি করতে পারেননি, কী আছে সামনে। ভাগ্য বদলের নেশায় তারা বিভোর তখন।
সোনার হরিণ হাতে পেতে মালয়েশিয়া যাত্রা শুরুর পরপরই খুলতে থাকে তাদের চোখ। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুর্গম সাগরপথে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অবর্ণনীয় অত্যাচারে হঠাৎ চোখ খুলে যাওয়া এ যুবকদের সামনে তখন না আছে সামনে যাওয়ার পথ, না আছে পেছনে ফেরার পথ।
এসব বন্দি বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করতে এবং পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল বিক্রি করে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পরিবারে হাসি ফোটানো তো দূরে থাক, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বন্দিশিবিরে অসহায়ত্বের গ্লানি টানছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে অহরহ প্রাণহানি ঘটছে, কেউ ধরা পড়ছেন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। কেউবা প্রতারকদের হাতে জিম্মি হচ্ছেন। সহায়-সম্বল বিক্রি করে টাকা দেয়ার পর মুক্তি মিলছে কারও।
হাইকমিশনের শ্রম শাখার প্রথম সচিব হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল জানান, বন্দি শিবিরে যারা আটক রয়েছেন, তাদেরকে দ্রুত দেশে পাঠানোর সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে দূতাবাসের শ্রম শাখার সচিবরা প্রত্যেকটি বন্দি শিবির পরিদর্শন করে বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব যাচাই এবং শনাক্ত করে পর্যায়ক্রমে তাদের দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, একটি ক্যাম্প থেকে তালিকা দিতে এক থেকে দুই সপ্তাহ বিলম্ব হওয়ায় দূতাবাস থেকে ট্রাভেল পাস ইস্যু করতে সমস্যা হয়। আবার ক্যাম্প থেকে তালিকা পাঠানো হলেও ব্যক্তির ফরম থাকে না। পরে ক্যাম্পে যোগাযোগ করে তা নিয়ে আসতে হয়। তারপরও দ্রুত বন্দিদের দেশে পাঠাতে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি।
যাদের কেউ নেই অথবা টিকিটের ব্যবস্থা হচ্ছে না, তাদের দূতাবাসের পাশাপাশি জনহিতৈষী কাজে নিয়োজিতদের সহযোগিতায় বিমান টিকিট দিয়ে তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এমআরএম/এমএস