গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে করা একটি মামলার বিচার চলাকালীন গত ১৭ জুন আদালতে মৃত্যু হয় মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির। তার এমন মৃত্যুতে দেশটির নাগরিকরা, এমনকি যারা তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে অপছন্দ করে, তারাও সহমর্মিতা প্রকাশ করছে।
Advertisement
দেশটির কর্তৃপক্ষ এবং একটি মেডিকেল সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার আদালতে মামলার শুনানিকালে মুরসি বিচারকের কাছে কথা বলার অনুমতি চান। আদালতের অনুমতিতে প্রায় ২০ মিনিট বক্তব্য রাখার পর হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন মুরসি। এ সময় উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মুরসির এমন মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে নারাজ তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এইচআরডাব্লিউ।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডাব্লিউ বলছে, বছরের পর বছর মুরসিকে অনেকটা সময় কারাগারে নিঃসঙ্গ রাখা, পরিবার ও আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে না দেয়া এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার কারণে মুরসির মৃত্যু হয়েছে।
Advertisement
মঙ্গলবার (১৮ জুন) সকালে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে খুব দ্রুত মুরসিকে দাফন করা হয়। এ সময় সাধারণ জনগণ ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
কায়রোর এক ব্যবসায়ী বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা খুবই দুঃখজনক যে, একটা দেশের প্রধান যিনি ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতাচ্যুত, তাকে গত মঙ্গলবার গোপনে দাফন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ ব্যবসায়ী বলেন, মুরসির বয়স হয়েছিল (৬৭) এবং তিনি অসুস্থ ছিলেন। আদালতে শুনানিকালে হঠাৎ অচেতন হয়ে মৃত্যু হয় তার। কিন্তু আদালতে যারা তার বিচার করছিলেন, তারা ভালো মানুষ ছিলেন না।
২০১৩ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মুরসির দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১১ সালে ব্যাপক সহিংসতার অভিযোগে করা মামলায় তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন দেশটির আদালত। পরে তা বাতিল করে পুনর্বিচারের আদেশ দেয়া হয়। সে সময় মুরসি এবং তার রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড দেশটির অন্যতম স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়।
Advertisement
আরও পড়ুন > মুরসির মৃত্যুতে যা বললেন এরদোয়ান
২০১৪ সালের ৮ মে মিসরের বহিষ্কৃত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসি কায়রোর এক আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ান। তার সমর্থকরা যে সময়েই তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন। ঠিক এ সময় মিসরের কর্তৃপক্ষ লক্ষ্য করলেন, দেশটির নাগরিকরা তার প্রতি সহমর্মিতা দেখাচ্ছে। তাই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলেন।
২০১১ সালে বিক্ষোভ শুরু হলে তিন দশক ধরে দেশটির কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বে থাকা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে সরিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেন মুরসি। চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও মাত্র এক বছরের মাথায় সেনা অভ্যুত্থানের মুখে ২০১৩ সালে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সেই সঙ্গে মিসরে তার রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা করা হয়।
এর পর থেকে সরকার বিরোধীদের ওপর বিশেষ করে ইসলামপন্থী সংগঠনের সদস্যদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। দেশের সব টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হতে থাকে যে, মুসলিম ব্রাদারহুড একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এ সংগঠন দেশের জন্য ক্ষতিকর।
মৃত্যুর পর দিন মঙ্গলবার সকালে সরকার দলীয় পত্রিকাগুলোতে মুরসি যে দেশটির একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন সে বিষয়টি উল্লেখ না করেই খবর ছাপে। দেশটির টিভি চ্যানেলগুলোতে বেশিরভাগ সময় বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসির সফরের খবর প্রচার করা হয়েছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ফাওয়াজ জর্জ বলেন, একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ মুরসি মিসরে তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। তাকে অদক্ষ হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু আদালতে তার মৃত্যুর ঘটনাটি অনেক মিসরীয়র চোখে এমনকি যারা ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে না, তাদের চোখেও মানবিক বিষয় হিসেবে ধরা দিয়েছে।
জর্জ আরও বলেন, যদিও মুরসি কোনো মহান নেতা ছিলেন না, তবে তার মৃত্যুটি প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। তার মৃত্যুতে দলের সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে পারে।
১৯২৮ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন হাসানুল বান্না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটিকে দমানোর জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চালায় সরকার। মিরসীয় পুলিশের গোপন বাহিনীর হাতে ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হাসানুল বান্না নিহত হন। এ সময় তাকে শহীদ আখ্যা দেয়া হয়। মুরসির মৃত্যু ব্রাদারহুডের শহীদের তালিকা আরও দীর্ঘ করল।
হাসানুল বান্নার মৃত্যুর পর ধুঁকতে থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের হাল ধরেন হাসানুল হোদায়বী। এ সময় মিশরীয় লেখক সাঈদ কুতুবও সংগঠনটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংগঠনটির আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ভাববাদী এবং প্রেরণাদাতা।
উচ্চশিক্ষার জন্য দুই বছর আমেরিকায় অবস্থান করেন কুতুব। ১৯৫০ সালে মিসরে ফিরে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড পুনর্জ্জীবনে উৎসাহী হন এবং ইসলাম ও রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ক অনেক উগ্রপন্থাধর্মী বই রচনা করেন। তিনি গোপনে কার্যক্রম শুরু করলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের তাকে কারাবন্দী করেন। নাসেরের শাসনামলে ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো।
সহিংসতার মাধ্যমে অনৈসলামিক সরকারকে উৎখাত এবং রাজনৈতিক ইসলামের প্রবক্তা ব্রাদারহুডের নেতা কুতুবকে ১৯৬৬ সালে ফাঁসি দেয় নাসের প্রশাসন। তাকেও শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রাদারহুড।
ক্ষমতায় আসার ১ বছর পর মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করায় সে সময় দেশটিতে ইসলামপন্থীদের হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। মুরসির মৃত্যুর ঘটনায় মিসর আবারও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সিএনএর গবেষণা কেন্দ্রের বিশ্লেষক জ্যাক গোল্ড।
এমএসএইচ/জেআইএম